ইউক্রেন যুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনের সাক্ষী বাংলাদেশি!

প্রকাশিত: ১:৪১ পূর্বাহ্ণ, |                          

সিদ্দিকুর রাহমান, স্পেন থেকে: বিশ্বের দরবারে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতি আলোচনার প্রধান খোরাক হয়ে উঠেছে। দিন যতই গড়িয়ে যাচ্ছে ততই মানুষের মাঝে বাড়ছে আশংকা। ইউক্রেন নয় শুধু যুদ্ধের দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে দেশ থেকে দেশান্তর। সবাই ভয়ে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দিকে দাবিত হওয়ার পরিস্থিতি অবলোকন করছে। দেশে দেশে শুরু হয়ে প্রতিবাদ। যুদ্ধ নয় শান্তি চাই আন্দোলন।
ইউক্রেন যুদ্ধে মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় বোমার আঘাতে এক বাংলাদেশী নাবিকের মৃত্যুর ঘটনায় আতংঙ্ক। সেই আতংঙ্কের ধাক্কা লাগে প্রবাসে অবস্থানরত প্রতিটি বাংলাদেশী নাগরিকদের মননে। যে মনন হয়ে উঠে অস্থির। ইউক্রেন যুদ্ধে এটাই প্রথম কোন বিদেশী যুদ্ধে প্রাণ হারান। কিন্ত যে সকল বাংলাদেশি নাগরিক ইউক্রেনে বসবাস করতেন তারা কেমন করে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে? কিভাবে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছে তার প্রশ্ন দেখা দেয় প্রতিটি বাংলাদেশীদের মনে। এরকমই একজন বাংলাদেশি নাগরিক নানা প্রতিকুল পরিবেশ ঢেলে সদ্য ইউক্রেন যুদ্ধের পরিস্থিতি নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করে স্পেনে এসে পৌছে।
আর রাশিয়ার আক্রমনে ইউক্রেনের জনগণের পাশাপাশি ভিন্ন দেশের নাগরিকরাও প্রত্যক্ষ করেছে যুদ্ধের বিভিীষিকাময় দিন গুলো। তাদের মধ্যে অনেক বাংলাদেশীদের মাঝে মো: শাহজাহান আহমদ খোকন ছিলেন। তার বাড়ী সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলায়। গত বছর ডিসেম্বর মাসে ইউক্রেনে পাড়ি জমান। সেখানে নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার আগেই যুদ্ধ পরিস্থিতির শিকার হন।
২৪ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার ভোর থেকে রাশিয়ার সেনাবাহিনী বিভিন্ন দিক থেকে ইউক্রেনের সামরিক স্থাপনা গুলোর ওপর হামলা চালাতে শুরু করে। বোমার আঘাতে ইউক্রেনের মাঠি কেপে উঠে। সারাদেশে সায়রন বাজিয়ে জনগণকে বিপদের বার্তা দেয়া হয়। তখন জনগণের মধ্যে দেখা দেয় আতংক। এই আতংঙ্কের মাঝে রাতেই কিয়েভ ছেড়ে পোল্যান্ড বডারে যাত্রা করে শত শত সাধারন জনগণ। সবার লক্ষ্য হয়ে উঠে নিরাপদ আশ্রয়। জনস্রোতের মাঝে স্থানীয় জনগনের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের নাগরিকরাও সামিল হয়। অন্ধকার বেড়ে চলার সাথে সাথে সুদুর থেকে কানে ভেসে আসে বোমার আঘাতের শব্দ। শহরের সব বাতি গুলো নিবিয়ে দেয়া হয়। সময়ের সাথে সাথে জীবন মৃত্যুর সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকি। মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে সামনে এগিয়ে যাই। এর সাথে কয়েকজন স্বদেশী বাংলাদেশীর সাথে যোগাযোগ করে কিয়েভের একটি স্থানে একত্রিত হই। কোথায় যাবো? কোন দিকে যাবো? কিভাবে যাবো? হাজার প্রশ্নের বেড়াজ্বালে আমরা আটকে যাই। তার সাথে আকাশে যুদ্ধবিমানের যাতায়াতে হতবম্ব হই। এই বুঝি কেউ মাথার উপর বোমা ফেলে আমার মৃত্যু নিশ্চিত করে দিলো। আমরা কয়েকজন একটি ট্রেক্সি ভাড়ায় কিয়েভ ছেড়ে প্রায় ২১ ঘন্টা যাত্রা করি। আমাদের গাড়ি যতই সীমানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ততই নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার মানুষের ঢল দেখতে পাই। একটি স্বাধীন দেশে বিদেশীদের আক্রমন কতটা র্মমান্তিক হয় তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা মশকিল। যুদ্ধের বিভীষিকা কতটা ভয়ানক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটা সময় আমাদের গাড়ীটি পোল্যান্ড সীমানা থেকে দুরে অবস্থান করলো। আমরা আরো ২০ কিলোমিটার পায়ে হেটে পোল্যান্ডের সীমানায় পৌছেন। কিয়েভ ত্যাগ করার সময় শুধু নিজের পড়নের কাপড় ছাড়া কিছুই সাথে আনতে পারিনি। নিজের পাসর্পোটটিও ফেলে আসি। রাজধানী ছেড়ে আসার সময় সেনা সদস্যের টহল ছিল। কিন্তু কেউ বাধা দেয়নি। পোল্যান্ড সীমান্ত চেকপোস্টে দেখলাম হাজার হাজার নিরাপদ আশ্রয় প্রার্থীর ভীড়। সেখানে ইমিগ্রেশন লাইনে কে কার আগে যাবে তা নিয়ে চলে প্রতিযোগীতা। তবুও দুইদিন দুই রাত খোলা আকাশের নিচে ঠান্ডা হাওয়ার মাঝে দাড়িয়েছি। পরে ইমিগ্রেশন জটিলতা শেষ করে প্রায় চার দিন পোল্যান্ডের ইমিগ্রেশনের নিরাপত্তায় ছিলাম। তারা আমাদের বাংলাদেশীদের জন্য আউটপাস দেয়। এই কাগজটিই একটি আইডি কার্ডের মতো গুরুত্ব বহন করে। পোল্যান্ড বাংলাদেশ দূতাবাস আমাদের অনেক সহযোগীতা করেছে বলে ইউক্রেনে প্রত্যক্ষদর্শী বাংলাদেশী নাগরিক তার অভিজ্ঞতা ও বিভীষিকাময় দিনের কথা র্বণনা করেন। বর্তমানে তিনি পরিবারের সাথে স্পেনে আশ্রয় নিয়েছেন।
সূত্র জানায় শুধু মাত্র খোকন নয়। ইতিমধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শত শত বাংলাদেশি নাগরিক আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের অবস্থা একই রকম। এর অর্ধেকের কম বাংলাদেশি নাগরিক ইউক্রেনে আটকে আছেন। আবার কেউ পথিমধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার প্রহর গুনছেন।
এদিকে ইউক্রেন বলছে, রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকে ৭৮ জন শিশুর প্রাণহানি হয়েছে। ইউক্রেনের মানবাধিকার ওম্বাডসইউমেন লিউডমিলা ডেনিসোভা বলেছেন, দক্ষিণের শহর মারিউপুল ও পূর্বাঞ্চলের শহর ভোলনোভাখা ও ইরপিন শহর কর্তৃপক্ষ হতাহতের সংখ্যা সঠিকভাবে জানাতে পারেনি।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন , ইউক্রেনের সঙ্গে মস্কোর আলোচনায় কিছু অগ্রগতি দেখা গিয়েছে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি তিনি। তিনি বলেছেন, দুই দেশের আলোচনায় কিছু ইতিবাচক বদল ঘটেছে। আমাদের আলোচনাকারীরা এ কথা আমাকে জানিয়েছেন। বেলারুশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে এ কথা বলেছেন পুতিন। সেইসঙ্গে জানিয়েছেন, দৈনিক ভিত্তিতে আলোচনা চলবে।
পূর্ব ইউরোপে স্বেচ্ছাসেবী পরিচালিত ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের জন্য সহায়তা সংক্রান্ত প্রচেষ্টায় ব্যাঘাতের সঙ্কেত। কারণ, কয়েকটি শহরে আশ্রয় শিবিরের অভাব দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যেই শরণার্থী সংখ্য়া ২৫ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। শরণার্থীদের ঢল এখনও অব্যাহত। পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, রোমানিয়া, হাঙ্গেরির মতো দেশগুলিতে ত্রাণের কর্মসূচি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির সহায়তায় প্রধানত কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন স্থানীয় জনগণ বলে জানাযায়।