সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় মহানবি (সা.) এর অনুপম আদর্শ

প্রকাশিত: ১১:১৮ অপরাহ্ণ, |                          

!!মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান!!

সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় মহানবি (সা.) এর অনুপম আদর্শ
আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টিকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি হলেন হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। তিনি বিশ্ব শান্তি, ঐক্য এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার সুন্দরতম মডেল। তিনি বিশ্ব শান্তি ও ঐক্যের প্রতীক এবং তাঁকে মানবতার মুক্তির দূত হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে।
ঝঞ্জা বিক্ষুব্ধ এ পৃথিবীতে শান্তি, ঐক্য, মানবতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যতটুকু অবশিষ্ট আছে; তা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর অবদান। পৃথিবীতে তিনিই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ মানুষ। কেয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য অনুপম আদর্শ। তাঁর অনুসরনের মধ্যেই রয়েছে মানুষত্বের পূর্ণ মর্যাদা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ” (সুরা আল আহযাব: ২১)। এই আদর্শ অবলম্বনেই রয়েছে ইহকালীন শান্তি এবং পরকালীন মুক্তি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরুপ” (সুরা আল কলম: ৪)। তিনি ছিলেন অতীত, বর্তমান এবং অনাগত ভবিষ্যতের একমাত্র পথ প্রদর্শক। স্থান, কাল, পাত্র, গোত্র, বর্ণ কোনো কিছুই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় কেমন; এটা শুধু তাঁকে দিয়েই মূল্যায়ন করা সম্ভব। তাঁর সম্পর্কে বিশ্বের মহাজ্ঞানীরা যে মন্তব্য করেছেন তা আরও বিস্ময়কর। আমেরিকার খ্রিস্টান পণ্ডিত MVH-Heart ১৯৭৮ সালে তার রচিত “The Hundred Ranking of the most influential Person in the history” বইতে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে। তার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, “He was the only succesful on both the relegion and secular levels.” এতে তার অনেক ভক্ত ক্ষুদ্ধ হয়ে তাকে পাগল বলেন। তখন তিনি তাদের প্রতি উত্তরে বলেন “প্রিয় বন্ধুরা আমি পাগল হইনি; যার নাম সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছি সমগ্র পৃথিবী তার জন্য পাগল হয়েছে।”
বর্তমান বিশ্বে মানবতা বলতে কিছু নেই, জাতিতে জাতিতে হানাহানি, রাহাজানি এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যে হারে বিস্তার লাভ করছে তা থেকে মানবতার মুক্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একমাত্র উপায় হলো তাঁর প্রদর্শিত পথে চলা। তাঁর এই মহান অনুপম পূর্ণাঙ্গ সত্তার সান্নিধ্যে এসেই গোত্রে-গোত্রে, বর্ণে-বর্ণে, জাতিতে-জাতিতে, শ্রেণিতে-শ্রেণিতে বিভক্ত ও বিপর্যস্ত পৃথিবী এককালে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের সন্ধান পেয়েছিল। কায়েম হয়েছিল প্রেম প্রীতিময়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অতুলনীয় সমাজ ব্যবস্থা। তাই বর্তমানেও মুক্তির সন্ধান করতে হলে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক জীবন এবং রান্নাঘর থেকে সংসদ ভবন পর্যন্ত সবকিছুতেই তার প্রদর্শিত পথের সন্ধান করতে হবে।
সম্প্রদায়
ইংরেজি কমিউনিটি শব্দের বাংলা অর্থ হলো সম্প্রদায়। সমাজবিজ্ঞানের পরিভাষায়, যখন কোনো গোষ্ঠীর সদস্যবর্গ এমনভাবে একত্রে বসবাস করে যে, তারা কতিপয় বিশেষ স্বার্থে অংশীদার না হয়ে বরং নিজেদের সংকীর্ণ জীবনযাত্রার অনুসারী হয়, তখন এমন যে কোনো জনগোষ্ঠীকে সম্প্রদায় বলা হয়। এছাড়া যখন কোনো একটি জনগোষ্ঠী কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে একই ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, মূল্যবোধ ইত্যাদির অনুসারী হয় এবং অন্য জনগোষ্ঠী থেকে নিজেদেরকে আলাদা ও স্বতন্ত্র মনে করে তখন তাদেরকে সম্প্রদায় বলে।
সাম্প্রদায়িকতা
সাম্প্রদায়িকতা মূলত সম্প্রদায় প্রত্যয়ের একটি বিশেষায়িত রূপ। যা সাধারণত নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যা সমাজব্যবস্থার মত বৃহৎ পরিসরকে বাদরেখে সমাজের ক্ষুদ্র অংশ, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনকে বুঝিয়ে থাকে। সমাজ বিজ্ঞানের পরিভাষায় সাম্প্রদায়িকতা হলো বৃহৎ সমাজের প্রতি আনুগত্য না করে বরং একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য করা।
সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক হলো একটি সম্প্রদায়ের মৌলিক নীতিমালা, যা সে সম্প্রদায়ের সকল সদস্যকে পারস্পরিক একতাবদ্ধ করে এবং অনুরূপভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একটি রাষ্ট্রের কাঠামোতে আবদ্ধ রাখে। কোনো কোনো সময়ে এসব সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ দেখা দিতে পারে এবং দেখা দেয়ও; যা পরবর্তীতে সাম্প্রদায়িকতায় রূপ নেয়। কোনো ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধাচারণ ও ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে।
সাম্প্রদায়িকতা হলো, জাতি বা রাষ্ট্রের কল্পিত সম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্যের চেয়ে বরং সম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনকে বাস্তবিকভাবে তুলে ধরে।
মোটকথা সাম্প্রদায়িকতা হলো জাতি বা গোষ্ঠীসমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সহিংসতাপূর্ণ অবস্থা যেখানে তারা সম্প্রদায়গত মৌলিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে থাকে এবং বর্ণগত উদ্দেশ্য লাভে একাগ্র থাকে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিভাষাটি দুটি শব্দের সমাহার। এগুলো হলো, ‘সাম্প্রদায়িক’ যার ইংরেজি প্রতিশব্দ communal এবং সম্প্রীতি যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Harmony. বাংলা অভিধানে সাম্প্রদায়িক শব্দটির অর্থ করা হয়েছে, দল গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় সম্পর্কিত, সম্প্রদায়গত ভেদবুদ্ধি বিশিষ্ট।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বলতে বিভিন্ন জাতি, দল বা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত মানুষের একই সমাজ বা দেশে একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করার নীতিকে বুঝায়। এমন সমাজ বা দেশে বিরাজমান বিভিন্ন আদর্শ ও মতবাদের অনুসারী ব্যক্তিদের মধ্যে কোনো প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ, সংঘাত-সহিংসতার পরিবর্তে পারস্পরিক ভালবাসা, সাম্য ও সৌহার্দভাব পরিলক্ষিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
নবুয়ত পূর্ব জীবনে মহানবি (সা.) এর অবদান
মহানবি (সা.) নবুয়ত পাওয়ার পূর্বে তাঁর চল্লিশ বছর কালীন জীবনে তিনি তৎকালীন অসহায় মানুষের প্রতি মহানুভব ছিলেন। কিশোর বয়স থেকেই তিনি বিবাদমান মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে সমাধানে এগিয়ে আসতেন।
প্রথম কর্মসূচি
হিলফুল ফুজুল গঠন: প্রাক ইসলামী যুগের ঘোর তমসাচ্ছন সময়ে জাজিরাতুল আরবে বিরাজ করছিল চরম অশান্তি। মানুষের মাঝে ছিল মানবতার অভাব। যুদ্ধ-বিগ্রহ, হত্যা-নৃশংসতা, মদ-জুয়া, নারীর অবমাননা, অসহনশীলতা ও চরম গোত্রীয় সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। বিশৃঙ্খল এই পরিবেশে সাম্প্রদায়িক আরব জাতি বছরের চারটি মাস ছাড়া সব সময়ই যুদ্ধে লিপ্ত থাকতো। এর ফলে মহানবি (সা.) এর নেতৃত্বে আরবের বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তি, দানশীল ও অতিথি পরায়ন আব্দুল্লাহ বিন জুদ’য়ান তাইমীর গৃহে অন্যায় এবং অনাচারের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনের জন্য একটি (Trade Union) সমিতি বা সংঘ গঠন করেন। যার নাম দেওয়া হয় হিলফুল ফুজুল। এভাবে রাসুল (সা.) নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্ব থেকেই মানুষে মানুষে সৌহার্দ সম্প্রীতি রক্ষায় অনুপম আদর্শ রেখেছেন গেছেন।
দ্বিতীয় কর্মসূচি
হাজরে আসওয়াদ স্থাপন: রাসুল (সা.) এর বয়স যখন ২৩/৩৫ বছর তখন যুদ্ধ প্রিয় আরব গোত্রসমূহ আবার রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মুখোমুখি হয় পবিত্র কাবা ঘর সংস্কার পরবর্তী হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে। এ সময় মহানবি (সা.) তাঁর বুদ্ধিমত্তার দিয়ে জাতির এই সংঘাতপূর্ণ অবস্থাকে শান্তিপূর্ণভাবে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান দিয়ে যুদ্ধের হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন করেন।
নবুওয়াত প্রাপ্তির পর মাক্কি জীবন তার অবদান
৬১০ খ্রিষ্টাদে নবুয়ত প্রাপ্তির পর কাফির মুশরিকরা তাঁর উপর অত্যাচারের খড়গ চালালেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন সদা সচেষ্ট। এ সময়ে তার কিছু কর্মসূচি উপস্থাপন করা হল:
বিদেশী অমুসলিমের অধিকার আদায়
মক্কায় রাসুল (সা.) ও সাহাবীগণের উপর কাফের মুশরিকদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ, অত্যাচার নির্যাতন যখন চরমে তখন মুরদ আরাশী নামক জনৈক ব্যক্তির পাওনা টাকা আদায়ের জন্য আবু জাহলের কাছে যান এবং তাকে টাকা পরিশোধ করে দিতে নির্দেশ দেন। আবু জাহল তৎক্ষণাৎ বিনা বাক্যে ভয়ে বিবর্ণ মুখে লোকটির সকল পাওনা পরিশোধ করে দেয়। এভাবে রাসুল (সা.) নিজের জীবনের পরোয়া না করে অমুসলিম বিদেশীর অধিকার আদায় করে দিলেন।
প্রতিশোধের পরিবর্তে ক্ষমা প্রদর্শন
চাচা আবু তালেব ও প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রা.) এর মৃত্যুর পর রাসুল (সা.) মক্কার বাহিরে ইসলামের প্রচার করার উদ্দেশ্যে তায়েফ গমন করেন। তারা তাঁর দাওয়াত কবুল না করে নির্মমভাবে তাঁর উপর অত্যাচার নির্যাতনের স্টিম রোলার চালায়। নবি (সা.) এর উপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে জিব্রাইল (আ.) প্রেরিত হন এবং রক্তাক্ত নবি (সা.) এর কাছে আল্লাহর আদেশে তায়েফবাসীদের পাহাড়ের চাপে পিষ্ট করার অনুমতি চান। কিন্তু মহানুভব নবি (সা.) প্রতিশোধ গ্রহণের সর্বোচ্চ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে ক্ষমা করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সৃষ্টির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
খ্রিষ্টান দাসের হাত থেকে খাদ্য গ্রহণ
যে সমাজে মানুষে মানুষে শ্রেণি বৈষম্য, উঁচু-নিচু বিভেদ; সেখানে মুহাম্মদ (সা.) এর দৃষ্টিতে ধনী গরিব স্বাধীন দাস সবাই সমান। বর্ণবাদ বা অদৃশ্যের কুসংস্কার হতে তিনি ছিলেন মুক্ত। তাইতো সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব রাসুলুল্লাহ (সা.) একজন খ্রিষ্টান দাস আদ্দাসের হাত থেকে খাবার খেতে কুণ্ঠাবোধ করেননি।
মুশরিকদের সাথে সৌজন্যমূলক সম্পর্ক
তায়েফ থেকে নির্যাতিত হয়ে নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) পর্যায়ক্রমে আখনাস বিন শুরাইক, সুহাইল বিন আমর এবং মুতইম বিন আদী এর নিকট আশ্রয় চান। অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও মুতইম তাঁকে আশ্রয় দিয়ে মক্কায় তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। (আল্লামা সাফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর রাহিকুল মাখতুম, ১ম খণ্ড ,পৃ. ৭৬)। নিজ সন্তানাদি ও সম্প্রদায়ের লোকদের সশস্ত্র পাহাড়া দিয়ে তিনি মহানবি (সা.) কে মক্কায় প্রবেশ করান এবং মসজিদে হারামে প্রবেশ করে সুউচ্চকন্ঠে ঘোষণা দেন, “হে কুরাইশগণ, আমি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে আশ্রয় প্রদান করেছি, কেউ যেন তাঁকে আর অনর্থক বিরক্ত না করে। এতে কুরাইশরা ভীতবীহবল হয়ে নির্যাতনের মাত্রা কমিয়ে দেয়। নবি (সা.) মুত‘ইম বিন আদীর উপকার ও সহৃদয়তার কথা কখনো ভুলেননি। বরং মুত‘ইম কাফির অবস্থায়ই বদর যুদ্ধের পূর্বে মৃত্যুর সংবাদে রাসুলুল্লাহ (সা.) তার সভা কবি হাসসান বিন সাবিতকে শোকগাঁথা লেখার নির্দেশ দেন। এমনকি বদর যুদ্ধের পর মক্কার যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির জন্য জুবায়ের বিন মুত‘ইম নবি (সা.) এর কাছে আসলে তিনি বলেন, “যদি মুত‘ইম বিন আদী জীবিত থাকতেন এবং এ দুর্গন্ধময় মানুষগুলোর জন্য সুপারিশ করতেন, তাহলে তাঁর খাতিরে ওদেরকে ছেড়ে দিতাম। মহানবি (সা.) এভাবেই অমুসলিমদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও সাম্ম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতেন।
মাদানী জীবনে সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় অবদান
বিশ্ব শান্তি অগ্রদূত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তাঁর মাদানী জীবনের উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি উপস্থাপন করা হলো-
মদিনায় বিভিন্ন জাতির সাথে সহাবস্থান
রাসুল (সা.) মদিনায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজে সাম্প্রদায়িক সাপ্রীতির যে নজির রেখেছেন তা ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে স্বীকৃত। মদিনায় এমন তিন প্রকার জাতির সাথে সম্প্রীতি স্থাপন করেছিলেন যারা পরস্পর ভিন্ন অবস্থা ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল। যেমন,
(ক.) মুসলিম জাতি: মক্কার মুহাজির ও মদিনার আনসার এ দুই শ্রেনিতে সমন্বিত। (খ) মদিনার পৌত্তলিক আদিবাসী গোষ্ঠী যারা তখনো ঈমান আনেনি (গ) ইহুদি সম্প্রদায়: মদিনার বিভিন্ন উপকণ্ঠে বসবাসরত কুচক্রি ইহুদি সম্প্রদায়। এদের মধ্যে প্রসিদ্ধ তিনটি গোত্র হলো, যুদ্ধ প্রিয় বনু কাইনুকা, বনু নযীর এবং বনু কুরাইযাহ। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সকল প্রকার ষড়যন্ত্রেও মোকাবিলা করে সকল ধর্ম ও গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন করে মদিনাকে শান্তির শহরে পরিণত করেন।
মদিনা সনদ ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মাইল ফলক
মদিনায় এসে মহানবি (সা.) ধর্মীয় ও জাতিগতভাবে বিভক্ত এক যুদ্ধবাজ জনসমষ্টিকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করার লক্ষ্যে “মদিনা সনদ” প্রণয়ন করেন। যাকে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান বলা হয়ে থাকে। এই ঘোষণাপত্রে রাসুল (সা.) কর্তৃক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনের যে প্রয়াস চালিয়েছিলেন তা হলো, প্রথমত: মুসলিমদেরকে অমুসলিমদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ও সতর্ক করার পাশাপাশি তাদেরকে এটাও অবহিত করেন যে, মদিনা রাষ্ট্রের অনুগত অমুসলিমরাও তাদের সমান নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। অনুরূপ ইহুদিদের মধ্যহতে যে ব্যক্তি আমাদের আনুগত্য ও অনুসরণ করবে সে আমাদের সমান অধিকার ও সাহায্য লাভ করবে। কেননা মুমিনদের রক্ষাকবচ সবার ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন। ইসলামের স্বার্থে কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হলে সে যুদ্ধে মুসলমানরা কোনো অমুসলমানের সাথে সমতা ও ন্যায়ের ভিত্তি ছাড়া আপোষ রফা করবে না। দ্বিতীয়ত, ইহুদিদের সাথে শান্তিচুক্তি; মহানবি (সা.) মদিনাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিপূর্ণ একটি সমাজ গড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি মদিনা সনদের মাধ্যমে প্রথমে মুসলমানদেরকে অমুসলিমদের প্রতি তাদের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত করেন। তারপর তিনি মদিনার অমুসলিম জনগোষ্ঠী বিশেষ করে ইহুদি জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও সমঝোতা গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। এজন্য সনদের দ্বিতীয় অংশে জানমালের সাধারণ নিরাপত্তা ও তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করে তিনি তাদের সাথে চুক্তি সম্পাদন করেন।
মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে আবু সুফিয়ানের প্রতি সাধারণ ক্ষমা: বদর, উহুদ ও খন্দকসহ বহু যুদ্ধের হোতা মক্কায় কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের প্রতি মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে মহানবি (সা.) সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে যে মহানুভবতা দেখিয়েছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে আশ্রিত হবে এবং যে নিজ ঘরের দরজা ভেতর হতে বন্ধ করে নেবে সে আশ্রিত হবে এবং যে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে সেও আশ্রিত হবে।
মক্কা বিজয় : বিধর্মীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা: যে মক্কার কাফির মুশরিকরা তাঁকে তাঁর জন্মভূমিতে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার অপরাধে একটি দিনের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেয়নি। তাঁর ও তাঁর সঙ্গী সাথীদের ওপর পরিচালনা করেছে অত্যাচারের খড়গ। তাদেরকে বাধ্য করেছে নিজেদের পরিবার পরিজন, সহায় সম্পদ ত্যাগ করে দেশান্তরী হতে। তাদেরকে তাদের অপরাধের শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে তিনি সেদিনকে ঘোষণা করলেন ক্ষমার দিন হিসেবে। কোনো রকম ধড় পাকড় নয় বরং তিনি ঘোষণা করলেন সাধারণ ক্ষমা।
জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্প্রীতি তৈরির আহ্বান: জাহেলি যুগ ছিল সাম্প্রদায়িকতার শীর্ষ যুগ। সাম্প্রদায়িকতাকে কেন্দ্র করেই যুদ্ধ বিগ্রহের সূচনা হলে তা বংশানুক্রমে চলতে থাকতো। সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্পে ধ্বংস হত নিরীহ মানুষের জীবন ও সম্পদ। এছাড়া তখন সমাজে আভিজাত্য ও কৌলিন্যের ভিত্তিতে মানুষের মর্যাদা দেওয়া হতো। এই কৌলিন্য ও অভিজাততন্ত্রের প্রচণ্ড চাপে আরবের অসংখ্য নারী-পুরুষ নিস্পেষিত হত। মহানবি (সা.) মক্কা বিজয় করে সকল অত্যাচার ও অবিচার, কৌলিন্য, অভিজাততন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতার মূলে কুঠারাঘাত করে সাম্যের ঘোষণা দেন।
মৃত অমুসলিমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন: রাসুলুল্লাহ (সা.) মৃত অমুসলিমদের প্রতিও সম্মান প্রদর্শন করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যেমন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমাদের পাশ দিয়ে একটি জানাযা অতিক্রম করছিল। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জন্য দাঁড়ালেন এবং আমরাও দাঁড়ালাম। অতঃপর বললাম, হে রাসুলুল্লাহ! এটি তো একজন ইহুদির জানাযা। তিনি বললেন, তোমরা কোনো জানাযা বহন করে নিয়ে যেতে দেখলে দাঁড়াবে। অর্থাৎ মৃত ব্যক্তি যদি ইহুদি, খ্রিষ্টান অথবা মুশরিকও হয় তবুও তাকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে তিনি নির্দেশ দিলেন।
জাতীয়তাবাদ নিষিদ্ধ: জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সৃষ্টির সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দেয়। তাই তিনি মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী জাতীয়তাবাদকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি জাতীয়তাবাদের জন্য যুদ্ধ করে অথবা জাতীয়তাবাদের দিকে আহ্বান করে অথবা জাতীয়তাবাদের সাহায্য করে অতঃপর নিহত হয়। তাঁর মৃত্যু জাহেলিয়াতের উপর হবে। যে ব্যক্তি কোনো সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের দিকে আহ্বান করে সে আমাদের কেউ নয় এবং আমিও তার কেউ না।
উপসংহার
রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষের মাঝে সাম্য, শৃঙ্খলা ও ঐক্য গঠন করে সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল ও অনুসরণীয় আদর্শ রেখে গেছেন। তিনি সাম্প্রদায়িক সংঘাতের মূলে করেছেন কুঠারাঘাত। ধর্ম, বর্ণ, রক্ত, গোত্র ও ভাষার পার্থক্যের ঊর্ধ্বে মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করে তাদের মাঝে সম্প্রীতির বন্ধন স্থাপন করেছেন। মহানবি (সা.) এর নীতি ও অদর্শে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। উপরন্ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বা বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে সুখি সমৃদ্ধশালী ও কল্যাণমুখী সমাজ এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণ করাই তার আদর্শের মূল শিক্ষা। আলোচ্য প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, মহানবি (সা.) সাম্প্রদায়িক ছিলেন না; বরং তিনিই প্রথম রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধে উঠে বিশ্বব্যাপী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করেন। সুতরাং প্রত্যেকেরই উচিত বিশ্ব শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় মহনবি (সা.) এর নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করা।

লেখক:কলামিস্ট ও গবেষক।