মণিপুরী ভাষা শহীদ সুদেষ্ণা দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত: ১১:২৮ অপরাহ্ণ, |                          

মণিপুরী ভাষা শহীদ সুদেষ্ণা দিবসে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে শোকর‍্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

(১৬ই মার্চ শনিবার) সকাল ১১ টায় উপজেলার মাধবপুর মণিপুরী ললিতকলা একাডেমির আয়োজনে শোকর‍্যালি ও শহীদ সুদেষ্ণার অস্থায়ী প্রতিকৃতিতে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

পরে একাডেমির অডিটোরিয়ামে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন ( উপ:পরিচালক অতি; দায়িত্ব) এর সভাপতিত্বে ও গবেষণা কর্মকর্তা প্রভাস চন্দ্র সিংহ এর সঞ্চালনায় সভায় অতিথি হিসাবে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আনন্দ মোহন সিংহ, বীর মুক্তিযোদ্ধা বীরেশ্বর সিংহ, মণিপুরী যুব কল্যাণ সমিতির সভাপতি প্রদীপ কুমার সিংহ, শিক্ষক বসন্ত কুমার প্রমূখ।

অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক নির্মল এস পলাশ । এর আগে সকাল ১০ টায় শিববাজার, শিবমন্দিরে শহীদ গিরিন্দ্র স্মৃতি পরিষদের আয়োজনে র‍্যালি,ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলী ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

শহীদ গিরিন্দ্র স্মৃতি পরিষদের সভাপতি উপেন্দ্র সিংহ এর সভাপতিত্বে অতিথি ছিলেন মণিপুরী যুব কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি নিখিল কুমার সিংহ, সমাজকর্মী রুপেন্দ্র কুমার, সার্বজনীন পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অনীল কুমার সিংহ, সমাজকর্মী দেবাশীষ সিংহ ও আনবিটেন এর সহ-সভাপতি সজিব সিংহ প্রমূখ।

৩২ বছর বয়সী সুদেষ্ণাই পৃথিবীর সর্বপ্রথম আদিবাসী ভাষাশহীদ, যিনি মাতৃভাষা স্বীকৃতির আন্দোলনে ১৯৯৬ সালের ১৬ই মার্চ মাতৃভাষার অধিকার চাইতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নৃশংস বন্দুকের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন তিনি।

পৃথিবীতে এ যাবত দু’জন নারী ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। সুদেষ্ণা সিংহ শহীদ হয়েছেন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনে ও কমলা ভট্টাচার্য আসামের বাংলাভাষা আন্দোলনে।

১৬ই মার্চ ভারত আসামের পাথারকান্দির কলকলিঘাট রেলস্টেশনে ৫০১ ঘণ্টার রেলপথ-রাজপথ অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে বরাক উপত্যকায় মণিপুরী ভাষাবিপ্লবীরা ১৯৫৫ইং সাল থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ।

আন্দোলনকারীদের একটি মিছিলে ভারতীয় পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে ঘটনাস্থলে গুলিতে প্রাণ হারান সুদেষ্ণা সিংহ। এ ঘটনায় অসংখ্য ভাষা বিল্পবী আহত হন এবং ব্যাপক ধরপাকড় হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর করিমগঞ্জ সদর হাসপাতালের বারান্দায় একটি স্ট্রেচারে অবহেলায় ফেলে রাখা হয় সুদেষ্ণার লাশ।

পরবর্তীতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা স্বীকৃতির আন্দোলনকে উপেক্ষা করতে পারে না আসাম সরকার। অবশেষে ২০০১ইং সালের ৭ই ফেব্রুয়ারী বরাক উপত্যকার ১৫২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় শিক্ষাদান চালু করে।

এরপর ২০০৬ইং সালের ৮ ইমার্চ ভারতের সুপ্রিমকোর্টের এক রায়ের মাধ্যমে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে ভারতের একটি স্বতন্ত্র ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী শহীদ সুদেষ্ণাকে সম্মান জানিয়ে বলে ‘ইমা সুদেষ্ণা’ ( মণিপুরী ভাষায় ইমা) শব্দের অর্থ মা।

নিজেদের ভাষাকেও তারা ‘ইমার ঠার’ অর্থাৎ ‘মায়ের ভাষা’ বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ভারতের আসাম প্রদেশের কাছাড় জেলার শিলচরে মাতৃভাষা বাংলার অধিকার চাইতে গিয়ে ১৯৬১ইং সালে মে মাসের ১৯ তারিখ যে ১১ জন বীরশহীদ আত্মাহুতি দেন তাদের মধ্যে ছিলেন প্রথম নারী ভাষাশহীদ মাত্র ১৭ বছরের তরুণী কমলা ভট্টাচার্য। আর ৩৫ বছর পর আবারো ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনে শহীদ হন সুদেষ্ণা সিংহ। সুদেষ্ণাকেই আদিবাসীদের মধ্যে সর্বপ্রথম ভাষাশহীদ গণ্য করা হয়। পৃথিবীতে এ যাবত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে এ দু’জন নারীই ভাষার জন্য লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছেন।

পৃথিবীর ভাষার ইতিহাসে এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জাতির ইতিহাসে এ ১৬ই মার্চ​ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। বাংলাদেশের পূর্বে এবং ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা কখনোই সুদেষ্ণার এ আত্মত্যাগের কথা ভুলেনি।

বাংলাদেশ-ভারত উভয়প্রান্তের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাভাষী মানুষ প্রতিবছর রক্তঝরা এ ১৬ই মার্চকে স্ব-ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে ‘শহীদ সুদেষ্ণার স্মরণে।