প্রবাসী এক ভাইয়ের বাস্তব গল্প

প্রকাশিত: ১০:২০ পূর্বাহ্ণ, |                          

একটা কোর্স করতে যখন দেশের বাইরে ছিলাম, তখন রবিন নামের এক বাংলাদেশী ভাইয়ের সাথে রুম শেয়ার করে থাকতাম। একদিন রুমে এসে দেখি উনি লাগেজ গোছাচ্ছেন।
আমি হেসে বললাম- দেশে যাবেন দেখে ভাই তো দেখি মহাখুশি!
রবিন ভাই লাগেজের চেইনটা লাগিয়ে হাসিমুখে বললো- “ভাই, ৮ বছর পর দেশে যাচ্ছি, মনে তো আনন্দ হবেই। ছোট বোনটাকে এতোটুকু দেখে এসেছিলাম, আর এখন তারই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে! বোনটা যখন আমাকে দেখবে, খুশিতে যে কি করবে এটা ভেবেই আমার চোখে পানি এসে যাচ্ছে।”
রবিন ভাই হাসিমুখে কথা বলছিলো, অথচ আনন্দে উনার চোখ জ্বল জ্বল করছিলো। এমন সময় রবিন ভাইয়ের বাবা ফোনে উনার কাছে জানতে চাইলো- “কিরে, শুনলাম তুই নাকি দেশে আসবি?”
রবিন ভাই হাসিমুখে উনার বাবাকে জানালো- “হ্যাঁ বাবা, আসবো। ছোট বোনের বিয়ে, বড় ভাই কি না এসে পারে?”
অপর প্রান্ত থেকে উনার বাবা বললেন- “তোর শুধু শুধু এতো টাকা খরচ করে আসতে হবে না! বিয়ে ঘরোয়া পরিবেশেই হবে। তাছাড়া নতুন জমি কিনেছি, টাকা-পয়সার একটা বিষয় আছে না? তাই আসার দরকার নেই!”
বাবার সাথে কথা বলা শেষে রবিন ভাই যখন ছোট বোনকে জিজ্ঞেস করলো- “কিরে, তুইও কি চাস আমি তোর বিয়েতে না আসি?”
ছোট বোন বললো- “এমনিতেই বাবা অনেক টাকা খরচ করছে। ৪০০ জন লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে গরু-খাসি কিনে এনেছে। এই অবস্থায় তোমার এতো টাকা খরচ করে দেশে আসতে হবে না!”
রবিন ভাই ফোনটা রেখে যখন লাগেজ থেকে কাপড়গুলো নামাচ্ছিলো, তখন উনাকে জিজ্ঞেস করলাম- ভাই, আপনি কি দেশে যাবেন না?
চোখের জল মুছতে মুছতে রবিন ভাই বললেন- “বাবা বিয়েতে আয়োজন করেছে ৪০০ লোকের। আমি গেলে তো ৪০১ জন হয়ে যাবে! ১ জনের দায়িত্ব বাবা নিতে পারবে না, তাই যাবো না!”
সেদিন নিজ চোখে একজন প্রবাসীর কষ্ট দেখেছিলাম, দেখেছিলাম একজন প্রবাসীর সাথে তারই কাছের মানুষগুলো কেমন নির্মম আচরণ করে…
প্রতিদিন কাজ শেষে রবিন ভাই তার ছোট ভাইকে ফোন করে বলতো, বাড়ির আশপাশটা একটু ভিডিও করে পাঠাতে, কিন্তু ছোট ভাই বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিতো, অথচ সেই ছোট ভাইকে কয়েকদিন আগেই রবিন ভাই বাইক কেনার টাকা পাঠিয়েছে।
আমি যখন নতুন আইফোন কিনলাম, তখন উনি আইফোনটা হাতে নিয়ে বললেন- “এটাই তাহলে আইফোন? যার জন্য মানুষ এতো পাগল!”
আমি বললাম- “আপনিও তো একটা আইফোন কিনতে পারেন। কি একটা ফোন ব্যবহার করেন, অর্ধেক ভাঙা!”
উনি হেসে বললেন- “কিনবো একটা আইফোন, ছোট বোনের জামাইয়ের জন্য!”
আমি উনার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলাম- সব প্রবাসীরাই কি এমন হয়, যারা নিজের জন্য একটুও ভাবেন না?
প্রতিদিন রাতে রাবিন ভাই খুব কাশতেন, একদিন উনাকে বললাম– ভাই, এবার অন্তত একটা ডাক্তার দেখান। আপনার শরীরের অবস্থা তো খুব একটা ভালো না।
উনি কাশতে কাশতেই বলতেন- “এখানে ডাক্তার দেখাতে যতো টাকা খরচ হবে, সেই টাকা দিয়ে বাবা নতুন একটা জমি কিনতে পারবে!”
আমি রেগে বলতাম– তাই বলে নিজের জন্য কিছুই করবেন না?
উনি হেসে বলতেন- “কয়েকদিন পর ডাক্তার দেখাবো। আসলে ছোট ভাইটা নতুন ব্যবসা করবে, তার জন্য আলাদা টাকা পাঠাতে হবে!”
এই অসুস্থার কারণেই রবিন ভাই একদিন হুট করেই পরপারে পাড়ি জমান। ফোনে যখন উনার বাবাকে বিষয়টা জানালাম, তখন উনি খুবই কান্না করছিলেন।
কিন্তু যখন বললাম- আমি লাশ পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। কিন্তু, লাশ দেশে পাঠাতে হলে আড়াই লাখ টাকার মতো লাগবে, আপনারা টাকার ব্যবস্থা করুন। তখন উনার গলার স্বর পাল্টে গেলো!
উনি আমতা আমতা করে বললেন- “এতো টাকা! যে ছেলে জীবিত থাকতেই দেশে আসতে পারলো না, তার লাশ দেশে এনে কি করবো? তোমরা ওখানেই কিছু একটা ব্যবস্থা করে ফেলো!
শেষবারের মতো ভিডিও কলে আমার ছেলের মুখটা একটু দেখাও তো!”
আমার তখন ইচ্ছে করছিলো উনার মুখে থুথু মারি। যে কিনা নিজের সন্তানকে টাকা বানানোর মেশিন ছাড়া কিছুই ভাবতো না!
ছোট ভাইকে ফোনে যখন বললাম- তোমার ভাই তো তোমার জন্য কতো কি করেছে, তুমি না হয় একটু লাশটা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো।
ছোট ভাই তখন উত্তর দিলো- “ভাই নাকি তার জন্য কোন কিছুই করেনি! একই রকম উত্তর ছোট বোনও দিলো! অথচ এই ভাই-বোনের সকল শখ-আহ্লাদ বড় ভাই বিদেশে কামলা খেটে পূরণ করছে!”
চোখের সামনে একটা মানুষের লাশ পড়ে আছে, অথচ আমার মনে হচ্ছে এটা মানুষের লাশ নয়! এটা একটা টাকার মেশিন, যেটা অচল হয়ে গেছে…
অনেক প্রবাসী আছেন, যারা বছরের পর বছর দেশের বাইরে কাটানোর পরও তাদের পরিবার চায় না মানুষটা দেশে ফিরে আসুক।
এক সময় সেই মানুষটা অমানবিক পরিশ্রম করতে করতে মারা গেলেও, মৃতদেহটা পরিবার দেশে আনতে চায় না টাকা খরচ হবে বলে, অথচ মানুষটা পরিবারের জন্যই আমৃত্যু কষ্ট করেছেন।
টাকার কাছে মানুষ সত্যি অসহায়, টাকার কাছেই মানুষ মনুষ্যত্ব হারায়, মানবিকতা হারায়, হারায় বিবেকবোধ…

🖋আবুল বাশার পিয়াস🖋️

সংগৃহীত।