রজনীগন্ধা ফুলের সুবাস আব্দুল আজিজ খান

প্রকাশিত: ৬:৩৪ অপরাহ্ণ, |                          

প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আব্দুর রব

একদিন কোন একটি কাজে সিলেট সরকারী মহিলা কলেজে যাই। কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষে বসে আছি। হঠাৎ কক্ষটির দেয়ালে একটি মার্বেল পাথরের ফলকে আমার চোখ আটকে গেলো। মার্বেল ফলকটিতে অনেকগুলো নামের সমাহার। যাঁরা কলেজটির প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে অবদান রেখেছেন সেসব বিদ্যোৎসাহী ত্যাগী পুরুষদের নামের স্বীকৃতি। এ নামের সমাহারে দেখলাম সিলেটের গোটাটিকর (পাঠানপাড়া) গ্রামের আবদুল আজিজ খানের নামটিও জ্বলজ্বল করছে। তিনি আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ‘রইদ চাচা’।
বছর ঘুরে আবার এলো মরহুম আবদুল আজিজ খান সাহেবের মৃত্যু বার্ষিকী। যাঁকে আমরা রইদ চাচা বলেই ডাকতাম। এটা তাঁর ডাকনাম। ‘রইদ’ শব্দটি রোদ বা রৌদ্র বাংলা শব্দের সিলেটী ভার্সন। আরবী ‘রাদ’ যার অর্থ বিদ্যুতের আলোক ঝলসানী – তা থেকে ‘রোদ’ শব্দের উৎপত্তি। অতি শান্ত ও স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব মন্ডিত রইদ চাচা কিন্তু চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার মত তীব্র আচরণ বা চরিত্রমন্ডিত লোক নন। রবং তাঁর ব্যবহারে ফুটে ওঠে মোমের আলোর মিষ্টি-মৃদু দ্যোতি বা চাঁদের মমতা মাখা জোৎস্নার শীতল পরশ মাখানো মোহনীয় আলো- যা’ মানুষ ও তার পরিবেশকে হকচকিয়ে না দিয়ে পরম আশ্বাস ও প্রগাঢ় আন্তরিকতার মোহময়তায় ভরিয়ে দেয়।
জনাব আবদুল আজিজ খান আমার রইদ চাচা সিলেট মহানগরীর গরীব ধনী, ছোট-বড় সবার কাছে তেমনি এক নির্ভরযোগ্য অভিভাবক শ্রেণীর পুরুষ। মানবীয় হীন হিংসা-বিদ্বেষ আর স্বার্থপরতার উর্ধ্বে উঠে তিনি মানুষকে ভালোবেসে মানুষের কল্যাণে জ্ঞানের আলোতে মানুষের মনের আঁধার দূর করতে মৃদু মোমের আলোরমত নিজে জ্বলে জ্বলে অপরকে আলোর মোহনীয় ঔজ্জ্বল্যে আলোকিত করে গেছেন তাঁর সারাটি জীবন ভরে। মানুষের বিপদে-আপদে, অসুখে-অভাবে নিজের ও পরিবারের কথা না ভেবে রইদ চাচা গরীব দুঃখী ও অপরের জন্য তাঁর সর্বস্ব বিলিয়ে গেছেন – একান্ত নীরবে-নিভৃতে। তিনি আত্ম-প্রচারক ছিলেন না।
১৯৭১ এর বিপন্ন দিনগুলোতে তিনি তাঁর আশপাশের অসংখ্য হিন্দু ও বিপদাপন্ন মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন নিজের জীবন বাজী রেখে। তাই দেশ মুক্ত হওয়ার পর তাঁর জীবনে যখন কিছু অনাকাঙ্খিত বিপর্যয় নেমে আসে তখন ঐ সংখ্যালঘু মানুষগুলোই কৃতজ্ঞতার বন্ধনে তাঁর পাশে এসে তাঁর মানবিকতা ও মহানুভবতার কথা প্রকাশ্যে বলে এবং তাঁকে বিপদ মুক্ত করতে সক্ষম হয়। এসব কথা জেনেছি, ’৭১ এ জনাব আবদুল আজিজ খান সাহেবের মহানুভবতা ও মমতায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া একজন হিন্দু ভদ্রলোকের কাছ থেকেই।
খুবই সাদা মাটা জীবন যাপনে অভ্যস্ত রইদ চাচা একজন অতি সাধারণ মধ্যবিত্তের মানুষ হয়েও চরম আত্মপ্রচার বিমুখ আচরণ নিয়ে যে মহান কর্মযজ্ঞ চালিয়ে গেছেন তা’ সত্যিই বিস্ময়কর। তাঁর জ্ঞানের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা ও ধর্মের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস তাঁকে সহজেই ঐ ভোগবাদী লোভাতুর জনসমাজ থেকে আলাদা করে চিনতে সাহায্য করে। এ সমাজে দেখা যায়- মানুষ ও দেশের জন্য উল্লেখযোগ্য কিছু না করেই সরকারী খরচায় কোন স্থাপনা তৈরীতে নিজের নাম যুক্ত করে অনেকেই সমাজে ‘হাতেম তাঈ’ বা ‘দানবীর’ খেতাবে স্বঘোষিত দাতা বনে যান। কিন্তু মোমের বাতির সাথে তুলনীয় আমার রইদ চাচা তার নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের মুখের গ্রাস থেকে বাঁচিয়ে নিজের নিতান্ত অপ্রতুল জায়গা-জমি বিক্রি করে স্কুল, মাদ্রাসা, অনাথ আশ্রম ইত্যকার অজস্র প্রতিষ্ঠান গড়ে গেছেন আর শত শত গরীব সম্বলহীন ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখা, আশ্রয় ও পরিণত ইয়াতিম যুবক-যুবতীদের বিবাহ শাদীর ব্যবস্থা করে গেছেন লোক চক্ষুর অন্তরালেÑ নিরন্তর নিঃস্বার্থতায় নিজেকে নিংড়ে দিয়ে। তিনি তাঁর সকল সন্তান-সন্ততিকে সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গেছেন। এখন তাঁর পরিবারের সবাই মাষ্টার্স কিংবা পিএইচডি, ডিগ্রীধারী, প্রতিষ্ঠিত দেশে বিদেশে কর্মরত। তাঁরাও তাঁদের আলোকিত নির্লোভ পিতার মত জ্ঞানের আলোকবর্তিকা নিয়ে মানুষ ও দেশের কল্যাণে নিয়োজিত।
আমার রইদ চাচা ‘রজনী গন্ধা ফুলের মতন’ শুধু সুবাস বিলিয়ে যান। জনাব আবদুল আজিজ খানের প্রজ্জ্বলিত মোমের বাতি অজ্ঞানতার আঁধার বিদূরিত করে আরো বহুদিন জ্বলতে থাকুক, এই দোয়া আমাদের। আমি
লেখক : পরিবেশ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আব্দুর রব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক, খ্যাতিমান পরিবেশবিদ, মানারত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর।