এলো নববর্ষ ঃ এলো বৈশাখ – মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

প্রকাশিত: ১২:৩২ পূর্বাহ্ণ, |                          

আমাদের মাঝে আবারও এলো বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ বৈশাখের একটা আবহমান ধারা গ্রামবাংলায় আমরা লক্ষ করে থাকি। অনুষ্ঠিত হয় নানান মেলা। হাটবাজারে পাওয়া যায় মাছ, ঘোড়া, গরু, পাখি, হরিণ মঠ জাতীয় চিনি সাজ এবং মিষ্টি জাতীয় ও মিষ্টি ছাড়া মুড়মুড়া বা আখরি (টাঙ্গাইলের ভাষা)।
এগুলো বৈশাখকে পরিচিত করে দেয় গ্রামবাংলায়। আর মেলায় চরকি ঘোরানো খেলাসহ নানা ঐতিহ্যভিত্তিক কর্মসূচি দেখা যায়। আর এ মেলা থেকে আম কাটার ছুরি বা চাকুই স্মরণ করিয়ে দেয় আম, কাঁঠাল ও লিচুর মওসুম এসেছে। আর এ সময় চিনি সাজ, মুড়মুড়া ও বিন্নি ধানের খই নিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যেতে দেখা যায়।
বৈশাখ মানে চৈত্রের খরতাপ শেষে কৃষকের কল্যাণে বয়ে যাওয়া শান্তির বারিধারা। কৃষক মহা আনন্দে আউশ ধান ও পাট চাষের প্রস্তুতি নেয়। ঐ কৃষকের জন্যই তার ছেলে সকালের খাবার পানতা ভাত নিয়ে যায় মাঠে। কয়েক দিনের মধ্যেই ছোটো ছোটো ধানগাছ ও পাটগাছ গজায়। আর চলে নিজের সন্তানের মতোই পরিচর্যা।
আবার বৈশাখ মানেই কালবৈশাখী ঝড়, টর্নেডো ইত্যাদি। মুহূর্তেই সব লণ্ডভণ্ড হয়ে প্রাণ হারাতে পারে বহু বনি আদমসহ অসংখ্য জীবজন্তু।
ষাটের দশকে দেখেছি কালবৈশাখী ঝড়ে সারস পাখি, শকুন, কাক ও শালিকসহ অসংখ্য পাখি নেতিয়ে পড়ে থাকতে। মনে হয়েছে যেন কালবৈশাখী ঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড করে গেছে। বাড়িঘর সব ওলট-পালট করে দিয়ে গেছে।
বাংলা বর্ষবরণের কোনো সুনির্দিষ্ট ইতিহাস পাওয়া যায় না। কারো কারো মতে বাংলা সন চালু করেছেন মোগল সম্রাট আকবর। বাদশাহি খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্যই নাকি তিনি হিজরি ৯৬২-৬৩ সনে প্রবর্তন করেছিলেন ফসল কাটার মওসুম। তাই ১৫৫৬ সালের ১১ই এপ্রিল বাংলা সনের শুভযাত্রা শুরু হয়েছিল। এই সনের নাম দেয়া হয় ‘ফসলি বছর’। তখন এই বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানাবার জন্য চলতো ঘরে বাইরে ব্যাপক প্রস্তুতি। সেই যুগের মানুষের বদ্ধমূল ধারণা ছিলো, নববর্ষের দিনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধান করলে গরু-বাছুরকে গোসল করানো হলে, কেউ কারো সাথে ঝগড়াঝাঁটি না করলে এমনকি আরো ভালো ভালো কাজকর্ম করলে সারাটা বছর ভালো যাবে।
অতীত ও বর্তমানকাল মিলে নববর্ষের আয়োজনে আমরা মিল ও অমিল খুঁজে পাই। বর্ষবরণ উৎসবের সূচনা সম্ভবত ‘হালখাতা’ থেকেই বলে অনুমিত হয়। ক্রেতাগণ নির্দিষ্ট কোনো দোকান (পাইকারি/ছোটো দোকান) থেকে বাকিতে কেনাকাটা করতেন। দোকানি একটা লাল রঙের খেরো খাতায় বাকির হিসাব লিখে রাখতেন বা এখনো লিখে রাখেন। নববর্ষের হালখাতা অনুষ্ঠানে কার্ড দিয়ে দাওয়াত জানানো হতো এবং এখনো জানানো হয়ে থাকে। ক্রেতাগণ কখনো পুরা পাওনা, কখনো আংশিক পাওনা পরিশোধ করতেন এবং এখনও করে থাকেন। দোকানি মিষ্টি দিয়ে সবাইকে আপ্যায়ন করতেন।
আকর্ষণীয় খেলাধুলার কথা তো রয়েছেই। ঘোরদৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, কুস্তি, লাঠি খেলা, তলোয়ার খেলা, নৌকাবাইচসহ নানা ধরনের খেলাধুলা অনুষ্ঠিত হতো আগেকার দিনে। গরুর দৌড় প্রতিযোগিতাও হতো। জোয়ালে একজোড়া করে গরু বেঁধে তার পেছনে মই বেঁধে দেয়া হতো। মইয়ের ওপর বসতেন গরুর মালিক। পুরনো ঢাকায় পায়রা উড়ানোর প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। গিরিবাজ পায়রাদের ওড়াউড়ি প্রতিযোগিতা দেখার জন্য লোকজনের ভিড় হয়।
নববর্ষে অনেক স্থানে ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতা হয়। বর্ষবরণ করার জন্য মেলা হচ্ছে গ্রামীণ মানুষদের একটি প্রাচীন উৎসব। মেলায় বিক্রি হয় মুড়ি-মুড়কি, খই, বাতাসা, কদমা মুরালি এসব খাদ্যসামগ্রী। কুমারেরা মেলায় নিয়ে আসে মাটির তৈরি ঘোড়া, ষাঁড়, হরিণ, বাঘ, ময়না, টিয়া, মাছ, আম, পেঁপে এসব। ছুতারেরা নিয়ে আসে কাঠের তৈরি শিশুদের খেলাঘর সাজানোর জিনিসপত্র, বাঁশি, ঢোল, ডুগডুগি এসব বাদ্যযন্ত্র ও রঙিন কাগজের তৈরি নানা রকমের ফুল তৈরি হয় মেলায়। নাগরদোলা ছাড়াতো মেলার রূপই খোলে না। হাজার বছরের ঐতিহ্যের এসব মেলাও আজ অনেকটা হারিয়ে যাচ্ছে।
বৈশাখ বরণ আবহমান বাংলার মধুর বৈশিষ্ট্য। গ্রামবাংলার রাখালের উদাস বাঁশির সুরে, জারি-সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদির সুর লহরিতে, ফুল-ফুলের মউ মউ সুরভিতে, একতারা হাতে বাউলের মনকাড়া গানে বেজে ওঠে বৈশাখের নূপুর ধ্বনি। বাঙালির ঘরে নতুন এই দিনটিকে ঘিরে আন্তরিক আয়োজনের ঘটা।
বিভিন্ন দেশে নববর্ষ উৎসবের আনন্দে অবগাহন করার রেওয়াজ রয়েছে। ইরানের অনুষ্ঠানের নাম নওরজ, চীন দেশে সামাজিকভাবে চান্দ্র নববর্ষের যে উৎসব ওরা উদযাপন করে তার নাম উনান দান। রাশিয়ার রাদুনিৎসা উৎসব। ইউরোপের ইংরেজি নববর্ষের উৎসব পালন করা হয়। ইহুদিদের নববর্ষের নাম রুশ হাশনা, ভিয়েতনামিদের উৎসবের নাম তেত।
আমাদের কৃষিপ্রধান দেশে একটি বছরের শেষ ও আরেকটির শুরুতে গ্রামীণ মেলায় অন্যান্য মনোহারি সামগ্রীর পাশাপাশি ফলফলাদি, কৃষিপণ্যও বিক্রি হয়। কৃষকেরা ঘরদোর সাফসুতরা করে আরো একটি বছরে ফসলের জন্য লড়াইয়ের সঙ্কল্প নেয়।
বাংলা নববর্ষ এখনো গ্রাম-বাংলায় ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে আছে। এ সময় গ্রামে ঘুড়ি ওড়ানোর ধুম পড়ে যায়। এরকম আরো কত কিছু আনন্দের উপাদান এখনো গ্রামবাংলাকে আগলে রেখেছে বৈশাখ।
ঐতিহ্যমণ্ডিত বৈশাখ তাই আমাদের কাছে এতো প্রিয়।