বাবা বলে ডাকতে না পারার ৩৬৫ দিন

প্রকাশিত: ৬:১৫ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৩, ২০২১ | আপডেট: ৬:১৫:অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৩, ২০২১

বাবা বলে ডাকতে না পারার ৩৬৫দিন

সৈয়দ মেহেদী রাসেল ও সৈয়দ ইউসুফ তাকি :

৩রা এপ্রিল ২০২০। গত বছরের এই দিন থেকে একদিন, দুই দিন, তিন দিন করে গুণতে গুণতে এক সম​য় এলো সপ্তাহ হিসেবে। কিছু দিন পর এক মাস, দুই মাস করে আজ এসে বছরে ঠেকেছে। এখন থেকে এক বছর, দুই বছর করেই দিন চলে যাবে বাবাকে ছাড়া। এই পৃথিবীর কত ব্যস্ততা অথচ বাবাকে প্রাণভরে বাবা বলে ডাকতে না পারার ৩৬৫দিন কতটা নিঃস্ব হয়ে যাওয়া; এ কেবল জানে বাবাহীন সন্তানেরা। বুকের ভেতর হাহাকার করে কেঁদে ওঠা প্রতিটা স্পন্দন জানে বাবা ছাড়া পৃথিবীটা কতটা কঠিন, যন্ত্রণার, হাহাকারের, অসহায়ত্বের।

একেকটা দিন বড় একা লাগে, বাবার স্পর্শটুকু, বাবার সেই মায়াভরা ডাক অথবা মাথায় হাত ভুলিয়ে দেয়া। বাবা থাকতে ভাবতাম, বাবা যদি না থাকেন, তবে আমি কিভাবে থাকবো! কেটে যাচ্ছে একেকটি দিন, মাস আর একেকটি বছর – বাবা নেই, আছে বাবার অনেকগুলো স্মৃতি, অনেকগুলো কথা, যা ভুলতে পারিনা, ভোলা যায়না।

আমার দেখা সাধারণে অসাধারণ মানুষদের একজন আমার বাবা। সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবন যাপন করা সৎ ও কর্মনিষ্ঠ এই মানুষটি আমার জীবনের আদর্শ। আজ বাবার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। বর্তমান পৃথিবীতে যখন এত কষ্ট, রোগ ও শোক, তখনও বাবা আমার এগিয়ে যাওয়ায় অব্যক্ত শক্তি।

আমার বাবা আমার কাছে বিশেষ এক আবেগ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, গর্ব। সেই গৌরব হারানোর বেদনা পৃথিবীর কোন কিছুর বিনিময়েই প্রশমিত হবার ন​য়। এ এক অবর্ণণীয় শূন্যতা, যা কেবল মিশে আছে হৃদয়ের রক্তক্ষরণে। বাবা স্বশরীরে বেঁচে নেই, তবু বেঁচে আছেন আমাদের মাঝে প্রতিমুহূর্তে। আমাদের ভালোর জন্য বাবা জীবনের প্রায় সবকিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করেছেন। কখনো নিজেকে ভালো রাখার চিন্তা করেন নি। বাবার চোখেই আমরা দেখেছি এই পৃথিবীর রূপ, রং ও আলোর দর্শন। বাবা শাশ্বত, চির আপন, চিরন্তন।

আমার জীবনে যদি বলি প্রাপ্তি তবে তা হলো – বাবা আমাদের মাঝে সততার বীজ বুনে দিয়েছিলেন। শিখিয়েছিলেন সততার চেয়ে নেই কিছু মহান এই পৃথিবীতে। বাবাই আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে মাথা উঁচু করে পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়।

বাবা মানে, সকল গল্পের পর্দার আড়ালে থাকা একজন মহানায়ক! আমার কাছে বাবা মানে গোটা পৃথিবী! আমার কাছে বাবা মানে পৃথিবীতে আমার অস্তিত্ব! আমার কাছে বাবা মানে আকাশ সমান অনুভূতির নাম! আমার সেই আকাশটা নেই! শুধু অনুভূতিটাই রয়ে গেছে একলা, একাকী! সেটাকে সঙ্গী করেই চলেছি, চলছি!

২০১৫ এর জুনে যখন যখন কানাডায় আসি, সেদিন রাতেই বাবা ব্রেইন স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। আমরা কানাডার ভোরের সূর্য দেখার আগেই দেখেছিলাম হাসপাতালের ইমার্জেন্সী রুম। প্রচন্ড উৎকন্ঠায় কেটেছিলো প্রতিটা সেকেন্ড। বাবার কি হবে? বাবা বেঁচে ফিরবেন তো? বেঁচে থাকলে সুস্থ হবেন তো আগের মত? হুমম সেবারের মত বাবা বেঁচে ফিরেছিলেন আমাদের মাঝে। কিন্তু সেই থেকে বাবার যেন নতুন ঠিকানা হয়ে উঠেছিলো মন্ট্রিয়লের জিউস জেনারেল হাসপাতাল। বাবার সাথে থেকে তখন আরো বেশী সম​য় কাটানো হতো। একদিক থেকেই ভালোই ছিল। ন​য়তো কাজে ব্যস্ততার অযুহাতে বাবাকে সম​য় দেয়া হতো না।

সেই সম​য়টায় বাবার সাথে আরো ঘনিষ্টতা বাড়ে। অবশ্য বাবার সাথে সখ্যতা নতুন কিছু ছিল না, ছোটবেলা থেকেই বাবা ছিলেন আমাদের সবচেয়ে ভাল বন্ধু। আমাদের বাবা ছিলেন অন্যরকম, সন্তানদের সাথে এতটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল সেটি ব্যাখ্যাতীত। বাবার শাসনেও আমরা আদর খোঁজে পেতাম। মায়ের বকুনি থেকে বাঁচার সবচেয়ে ব​ড় রক্ষাকবচ ছিলেন বাবা। বাবার সাথে প্রতিদিন কতশত গল্প হতো, কত শত হাসি কান্নার মূহুর্ত। আমাদের বাবা আমাদের সাথে খুব মজা করতেন, কৌতুক করতেন।

বাবা যখন ব্রেইন স্ট্রোকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে শরীরের বাম অংশ কিছুটা অবশ হয়ে গেলো, বাবা তখন হাঁটতে ভুলে গেলেন। বাবাকে আমরা ভাই বোনেরা মিলে আবার হাঁটতে শেখালাম বাচ্চাদের মত। ঠিক যেমন বাবা আমাদের শিখিয়েছিলেন। আসলে এর পর থেকেই বাবা হয়ে গেলেন আমাদের সন্তানের মত। বাবাকে মুখে তুলে খাওয়াতাম, গোসল করিয়ে দিতাম। এত শত কাছে ঘেষার স্মৃতি, কত শত আলিঙ্গনে বাবার গায়ের ঘ্রাণ নিজের শরীরে মেখে নেয়ার স্মৃতি মনকে বিষন্ন করে তোলে।

তবু মনে অনাবিল আনন্দ আর গর্ব নিয়ে বেঁচে থাকি এমন বাবার সন্তান হতে পেরে। বাবা ছিলেন একজন ভাল মানুষের সবচেয়ে ভাল উদাহরণ। বাবার সবচেয়ে বড় গুন হল, তিনি মানুষকে খুব ভালবাসতেন এবং বিশ্বাস করতেন। যেকোন মানুষকে ভালবাসতেন, কাছে ডাকতেন পরম স্নেহ মমতা নিয়ে। একজন মাছওয়ালা কিংবা সবজিওয়ালাকেও বাবা অনেক সম্মান দিতেন, কখনো আর্থ সামাজিক অবস্থানের জন্য কাউকে ছোট করে দেখতেন না। বাবা আজীবন শুধু মানুষের উপকার করতে চাইতেন। সেইসব মানুষের অবারিত ভালবাসায় বাবাকে সিক্ত হতে দেখেছি। বাবার মৃত্যুর পর কত শত মানুষ বাবার জন্য কান্না করেছে, আমাদেরকে জানিয়েছে নীরবে নিভৃতে বাবা কিভাবে তাদের সাহায্য করেছেন।

আমার জীবনের আমৃত্যু নায়ক, আমার জীবন চলার পাথেয় আমার বাবা। বাবা সব সম​য় একটি কথা বলেন, “মানুষকে ভালবাসতে পারায় ক্ষতি নেই বরং নিজের হৃদয় বিশুদ্ধতায় পরিপূর্ণ হয়”। সেই কথাগুলি খুব মেনে চলার চেষ্টা করি। বাবার অণুপ্রেরণায় আমরা দুই ভাই মানুষের পাশে দাড়াই, মানুষকে ভালোবাসা বিলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা জানি বাবা দূর আকাশের নক্ষত্র হয়ে আমাদের দেখে প্রাণভোলানো সেই হাসি দেবেন। যে হাসি আরো একটিবার দেখার জন্য আকুল হয়ে আমাদের প্রাণ কাঁদে।

বাবা ছাড়া এই পৃথিবী যেন লক্ষ্যহীন অযুত কোটির ছায়াবীহীন এক সীমাহীন পথ। সেই পথে চলতে আমাদের বাবা অদৃশ্য এক ছায়া হয়ে থাকেন আমাদের সাথে। অনেকদিন হ​য় কেউ ডাকে না আমায় প্রিয় নাম ধরে, কেউ বলেনা বাবা আজ ফিরতে এত দেরী হলো কেন? পরম স্নেহে পরশে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার কেউ নেই আজ। তবু আমার বাবার মতো এমন অসংখ্য বাবা বেঁচে আছেন তাদের সন্তানদের কর্মে-ভাবনায়-অনুপ্রেরণায়।

বাবা যখন ব​য়সে অনেক তরুণ, তখনো বিয়েই করেননি সেই বয়সে একবার পবিত্র হজ্ব পালন করেছিলেন। আমাদের বাবার খুব ইচ্ছে ছিলো আমরা দুই ভাই মা বাবাকে নিযে একসাথে পবিত্র হজ্ব পালন করে আসবো। কিন্তু মহান আল্লাহর ইচ্ছায় সেটি পূরণ হ​য়নি। কিন্তু আল্লাহ নিশ্চ​য়ই আমাদের বাবার সেই নেক ইচ্ছাকে কোনভাবে পূরণ করে দেবেন।

আমাদের বাবা সহ এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া প্রত্যেক বাবাকে যেন মহান আল্লাহ তালা জান্নাতবাসী করেন। ‘হে আমার রব! তাঁদের প্রতি দয়া করো যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাদের প্রতিপালন করেছিলেন।’ আমীন।

যারা বেঁচে আছেন – ভালো থাকুন পৃথিবীর সব বাবা। শ্রদ্ধাঞ্জলি সব বাবাকেই।

লেখক: সৈয়দ মেহেদী রাসেল – প্রকাশক ও সম্পাদক ও সৈয়দ ইউসুফ তাকি – নির্বাহী সম্পাদক : বঙ্গবাণী।