মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী লোপাকে একা পেতে চাচ্ছিলেন; সাথে পিতাকে নিয়ে গেলে মন্ত্রী ক্ষেপে উঠেন: লোপার স্ট্যাটাস

প্রকাশিত: ১০:০১ পূর্বাহ্ণ, |                          

২০০৫ সালে ‘তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সংগীতাঙ্গনে আত্মপ্রকাশ লোপা হোসেনের। প্রথম এককে প্রীতম আহমেদের লেখা ও সুর করা ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ গানটি ২০১৫ সালে নতুন সংগীতায়োজনে গেয়ে ভিডিও আকারে প্রকাশ করেন লোপা। এটির জন্য সবার প্রশংসাও পান। তবে লোপার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অর্জন দ্বিতীয় এককে বেলাল খানের সঙ্গে গাওয়া ‘সামান্য সম্বল’। এই গানই লোপাকে বেশি পরিচিতি দিয়েছে।

সঙ্গীতশিল্পী লোপা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রীকে নিয়ে ফেইসবুকে একটি ট্যাস্টাস দিয়েছেন যা এখন টক অব দ্যা কান্ট্রি। সেখানে লোপা দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সাথে দেখা করতে চাইলে আমি একা যাচ্ছি কিনা তা বারবার জানতে চাইলে জানাই যে আমি একাই যাচ্ছি। কিন্তু আব্বাও আমার সঙ্গে যেতে চাইলে আমি তাঁকেও নিয়ে যাই৷ আর তিনি ক্ষেপে উঠেন।

সঙ্গীতশিল্পী লোপার স্ট্যাটাস পুরোটাঃ
গতকাল মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের ‘মাননীয়’ মন্ত্রী’র সাথে দেখা হবার ঘটনাটি আজ শেয়ার করছি আপনাদের সাথে। কারণ গতকাল এতটাই ভেঙে পরেছিলাম, যে লেখার মত শারীরিক এবং মানসিক শক্তি ছিলনা৷ অনেক বড় লেখা, ধৈর্য ধরে পড়ার অনুরোধ রইল।

কয়েকবছর ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাইবাছাই করা হচ্ছে যা খুবই ভালো উদ্যোগ ৷ আমার আব্বা সেই বাছাইগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই উতরে গেছেন। কিন্ত জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কমান্ড কাউন্সিল এর সর্বশেষ বাছাই তালিকা থেকে আব্বার নাম বাদ দেয়া হয়েছে যা আমাদের জন্য বিস্ময়কর ৷ আব্বা আপিল করেছেন। কিন্তু এই ঘটনায় উনি ভীষণভাবে ভেঙে পরেছিলেন৷ বাসা থেকে তার বের হওয়া নিষেধ। আমাদের কাউকে না জানিয়ে তিনি রূপগঞ্জ এবং জামুকা অফিসে গেছেন। এই কষ্ট তাঁকে ঘুমাতে দেয়নি কয়েকরাত। এরপরই মূলত আব্বা অসুস্থ হয়ে যান,তাঁকে হাসপাতালে সিসিইউতে রাখা হয় এবং হার্টে পেস মেকার পরাতে হয়। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে তাঁকে এবার জীবিত ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়৷ আমি আব্বাকে আশ্বাস দিয়েছিলাম যে আমি মাননীয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর কাছে বিষয়টা নিয়ে যাবো৷ তিনি নিশ্চয়ই তোমার উপর এত বড় অবিচার হতে দেবেন না।

গত পরশু (১৮ মে) মাননীয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক কে ফোন করি। তিনি আমাকে আগে থেকেই চিনতেন৷ তাঁর হাত থেকে একাধিকবার পুরস্কার নেয়ার অভিজ্ঞতা আছে। এছাড়া আমার আম্মাকেও তিনি আওয়ামী সাংস্কৃতিক জোট এর সহ সভাপতি হিসেবে চিনতেন৷ আমি তাঁর সাথে দেখা করতে চাইলে তিনি পরেরদিন ১৯ মে বিকেল ৩ টায় যেতে বলেন। আমি একা যাচ্ছি কিনা জানতে চাইলে জানাই যে আমি একাই যাচ্ছি। কিন্তু গতকাল সকালে আব্বাও আমার সঙ্গে যেতে চাইলে আমি তাঁকেও নিয়ে যাই৷ যে ব্যবহার, যে অপমান তিনি করেছেন,তার জন্য আমরা একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না৷ তিনি পুরোটা সময় আমাদের দাঁড় করিয়ে রাখলেন। একা যাবো বলেও বাবাকে সাথে নিয়ে গেছি এটাই কারণ কিনা জানিনা, ২৪ ঘন্টারও কম সময়ে ওনার ব্যবহারে আকাশ পাতাল তফাত৷ আব্বার হাত পা কাঁপছে দেখে আমি তাঁকে একটা চেয়ারে বসাই। মন্ত্রী পুরোটা সময় আমাদের সাথে মিসবিহেইভ করে গেলেন। আব্বা এতে ভয় পেয়ে কথা হারিয়ে ফেলছিলেন। আমি কথা বলতে গিয়ে আবার ধমক খেলাম – ‘আপনি কথা বলেন কেন? আপনাকে চুপ থাকতে বলেছি না ?’ আব্বাকে ধমক দিয়ে বললেন – ‘আপনারা কি আমার চেয়ে বেশি বোঝেন? সরকার আমাকে এত্তগুলা টাকা দিয়া এই চেয়ারে বসাইসে, এগুলা আমি বুঝবো।’

তিনি জানিয়ে দিলেন যে, আপিলে জামুকা যা সিদ্ধান্ত নেবে,সেটাই ফাইনাল। আমি পুরোটা সময় একটা বাক্যও বলতে পারিনি ওনার ধমকের জন্য । দরজার কাছাকাছি এসে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম – ‘যদি জামুকার কর্তারা রায় দেয় যে আমার আব্বা মুক্তিযোদ্ধা নন,তাহলে কি সেটাই সত্য হয়ে যাবে? সেটাই মেনে নিতে হবে?’

তিনি বললেন- ‘নয়তো কি?’ কথাটা শোনার পর আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। লিফটের কাছাকাছি এসে দেখি আব্বার হাত খালি৷ তিনি মন্ত্রীর দুর্ব্যবহারে এতটাই ভড়কে গিয়েছেন যে ওনার টেবিলেই মোবাইল ফেলে এসেছেন। আব্বার সাথে এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন আব্বা তার অফিসের কেরানি। পুরোটা সময় গাড়িতে বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন -মামনি,উনি এমন ব্যবহার করলেন কেন তোমার সাথে?

আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা, রুপালি ব্যাংকের সাবেক ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মো: গুলজার হোসেন। তিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ নং সেক্টরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন এবং দেশ স্বাধীন করেই ঘরে ফিরেছেন৷ জাতির জনক কর্তৃক প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা সনদও পেয়েছেন৷ আমাদের বাবা আমাদের পুরো পরিবারের গর্ব। ওনার যুদ্ধে যাবার নানা গল্প আমি যে কেবল আমার আব্বার মুখে শুনেছি তা নয়, আমার মরহুম দাদা – দাদী, চাচা, ফুপু, আত্মীয়স্বজন, আব্বার অনেক বন্ধু এবং রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন, কেন্দুয়া গ্রামবাসীর কাছেও শুনেছি৷ সেখানে আব্বাকে সবাই বিশেষভাবে সম্মান করে।

প্রতিবছর আব্বা অন্যসব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সেখানকার বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস এর অনুষ্ঠানে সম্মাননা পান৷ কিন্তু কিছু জীবাণু টাইপের লোক সবজায়গাতেই থাকে। সেরকম দুএকজন মাঝে মাঝে আব্বাকে খোঁটাও দেয় এই বলে – ‘ভাই,আপনারে তো আল্লাহ কম দেয়নাই। এই ১০০০০ টাকা ভাতা নিয়া কি করবেন?’ সত্যি,আমাদের এই ভাতার প্রয়োজন নেই৷ আমার আব্বা দীর্ঘ ১৮ বছর আমেরিকায় চাকরি করেছেন। কষ্টার্জিত উপার্জনে বাড়ি-গাড়ি করেছেন৷ রিটায়ার্ড হয়ে চলে আসার পর তাঁর অফিস তাঁকে প্রতিমাসে একটা ভালো এমাউন্ট পেনশন হিসেবে পাঠায়। আমার এবং আমার ভাইয়ের লেখাপড়া বা অন্য কোন কাজে কোনদিন আব্বার মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহারের প্রয়োজন হয়নি৷ আমাদের ভাতার দরকার নেই৷ আমি আমার বাবার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি চাই, মৃত্যুর পর সম্মানের সাথে সমাহিত করা নিশ্চিত করতে চাই।

অস্ত্র হাতে দেশ স্বাধীন করার ৫০ বছর পর তাঁকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানোর ষড়যন্ত্র যে বা যারা করছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আমি একাই লড়বো। জামুকা আগের রায় বহাল রাখলে হাইকোর্টে রিট করবো৷ আমার শরীরে একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধার রক্ত বইছে, আমি রাস্তায় পুলিশের মার খাওয়া একজন আওয়ামী লীগ নেত্রীর সন্তান৷ আমার কোন অভদ্র মন্ত্রীর দয়ার প্রয়োজন নেই।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু