কবি নজরুল বাংলা সাহিত্য জাগরণে অনুপ্রেরণা জোগায়

প্রকাশিত: ২:২৬ পূর্বাহ্ণ, |                          

!! মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান!!
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে বিশ্বমাপের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি বাংলা সাহিত্যের আকাশে ভোরের শুকতারার মত চিরন্তন ও ভাস্বর। রবীন্দ্র যুগে (১৮৬১-১৯৪১) রবীন্দ্র প্রতিভার মধ্যগগনে চোখ ঝলসানো দীপ্তির ভেতরে বাংলা সাহিত্যের আর সব অগ্রজ কবি-সাহিত্যিকরা যখন জোনাকীর মত ম্রিয়মান; বাইশ বছরের ভবঘুরে বাউন্ডুলে যুবক কাজী নজরুল ইসলাম তখন জেগে উঠলেন বিদ্রোহের বিদ্যুৎ দীপ্তিতে; বিশ শতকের তৃতীয় দশক বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের উত্থানের যুগ। যথার্থভাবে তিনিই প্রথম কবিতায় রবীন্দ্র প্রভাব বলয় সম্পূর্ণ অতিক্রম করে কার্য্য ক্ষেত্রে এক নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি করতে সমর্থ হলেন। আজ থেকে শতাধিক বছর পূর্ব হতে তিনিই আমাদের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম সাহিত্য প্রতিভা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের অনন্যসাধারণ প্রতিভার ব্যাপ্তি স্মরণে রেখেও নজরুল সম্পর্কে আমরা যৌক্তিকভাবে এই শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কথা উচ্চারণ করতে পারি। তিনি বাঙালি ও বাংলাদেশীদের জাতীয় কবি।
রবীন্দ্র-নজরুল প্রসঙ্গ নিয়ে শুরুতেই আরো একটু নিবেদন : স্বীকার করি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ অনেক বড় ও বিস্ময়কর প্রতিভা। কিন্তু নজরুলের শ্রেষ্ঠত্বের সাথে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কোন দ্বনদ্ব নেই, আছে পার্থক্য। এই পার্থক্য দুই শ্রেষ্ঠ কবির দৃষ্টিতে, সৃষ্টিতে, মানসে, মনোভূমিতে এবং উচ্চারণে ও উপস্থাপনে। এই পার্থক্য বিপুল-বিশাল। প্রায় হিমালয় গিরিসদৃশ্য অনেক সৃষ্টি করেও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, ‘আমার কবিতাখানি, জানি আমি; গেলেও বিচিত্র পথে হয়নি সে সর্বত্রগামী’ ‘যে আছে মাটির কাছাকাছি, সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি’। বিশ্ব কবির প্রত্যাশিত এই কবি যে কাজী নজরুল তা আজীবন ‘গুরু শিষ্যের’ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ও নজরুল রচনাবলী থেকে তা বুঝতে যথার্থ সমঝদারদের কষ্ট হবার কথা নয়। প্রসঙ্গত: দু’ একটি ঘটনা উল্লেখ্য। ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট নজরুলের সম্পাদনায় ‘অর্ধসাপ্তাহিক’ ধূমকেতু প্রকাশিত হলে রবীন্দ্রনাথ যে আশীর্বাদ পাঠান, ‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু —– জাগিয়ে দে রে চমক মেরে আছে যারা অর্ধচেতন।’ ফলে নজরুল দারুণভাবে অভিভূত ও অনুপ্রাণিত হন। এর ছ’মাস পরে ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে উৎসর্গ করেন তাঁর গীতিনাট্য ‘বসন্ত’। নজরুল তখন আলীপুর জেলে বন্দী। নজরুলের আকৈশোর সৃহৃদ পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে ডেকে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ গীতি নাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি। তাঁকে বল, আমি নিজের হাতে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না পায়।’ উৎসর্গ পত্রে নজরুলকে ‘কবি’ বলে অভিহিত করায় রবীন্দ্রনুরাগীদের অনেকেই ঈর্ষান্বিত হন। প্রসংগত আরো উল্লেখ্য, ১৯২৩ খৃস্টাব্দের মে মাসে হুগলী জেলে অনশনরত ২৪ বছর বয়স্ক নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ (ষাটোর্ধ রবীন্দ্রনাথ দেশে কবিগুরু ও বিদেশে বিশ্ব কবি বলে স্বীকৃত) দেশবাসীর সাথে উদ্বিগ্ন হয়ে টেলিগ্রাম করলেন “Give up hunger-strike. Our literature claims you”। এ প্রসঙ্গে প্রভাত মোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এর স্মৃতিচারণ থেকে উদ্ধৃতি দেয়া বোধ করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ‘‘১৯৩০ সালে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে এক নতুন অভিজ্ঞতা হয়। ‘রবীন্দ্রনাথ বড় কবি না নজরুল বড় কবি’ এই নিয়ে দু’দলের এক হাতাহাতি শেষে থালাবাটি ছোড়াছুড়িতে পরিণতি লাভ করে। আমার মুখে সেই ঘটনার বিবরণ শুনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সেই থালাবাটির আঘাত যে আমারই গায়ে লাগবে। আমার ভক্তেরা বোধ হয় সেকথা ভুলে গেছিল।’’
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধু বিংশ শতকে নয়, একবিংশ শতাব্দিতেও এক মহান মানবতাবাদী উপনিবেশবাদ ও আধিপাত্যবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চির বিদ্রোহী কবি। অনন্য সাধারণ ও আপোষহীন সরকার বিরোধিতার খেসারত কবিকে দিতে হয়েছে বহুকাল কারাভোগ করে। নজরুলের জীবদ্দশায় তাঁর অসাধারণ কবি প্রতিভার বিরূদ্ধে বিরুপ সমালোচকও কম ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে তখন যে কবি বলয় সৃষ্টি হয়েছিল তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন নজরুল বিরোধী। এই বিরোধিতা যত না ছিল সাহিত্যগত তার চেয়ে বেশি ছিল সম্প্রদায়গত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভক্তদের এই অনুদার মনোভাবকে উৎসাহিত করতেন না। তিনি নানাভাবে নজরুলকে বাংলা সাহিত্যের অংগনে স্বাগত জানাতেও দ্বিধা ও দেরী করেননি। প্রাজ্ঞ জহুরীর ন্যায় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর বিপুল কবি প্রতিভার বাইরে নতুন প্রতিভার উদয় হয়েছে। এবং তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করবেনই। বিশ্বকবির এই দৃষ্টিভংগী ছিল সঠিক ও প্রশংসনীয়। ‘ধূমকেতু’র জন্য পাঠানো আশীর্বাদবাণীতে দেশ ও জাতির সেই ঘোরতর দুর্দিনে পরাধীন দেশবাসীকে জাগিয়ে তুলবার প্রয়াসে এই তরুণ বিদ্রোহী কবির প্রতি রবিন্দ্রনাথ যে গভীর আস্থা স্থাপন করেছিলেন, নজরুল তা রক্ষা করতে চেষ্টার কোন কসুর করেননি। অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব হিসাবে কাজী নজরুল ইসলামকে তৎকালীন বাংলার হিন্দু-মুসলমান মিলনের অগ্রদূত হিসাবে গণ্য করা হলেও যৌক্তিক কারণেই তিনি স্বীয় সম্প্রদায়ের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি উজ্জীবনের পথিকৃৎ হিসাবেই অধিকতর পরিচিত ও পরিগণিত হয়েছিলেন।
নজরুলের জাতীয়তা : জাতি ও জাতীয় সাহিত্যের সংজ্ঞা কি, কি কি উপাদানে জাতি গঠিত হয়, এ নিয়ে নানা মুনীর নানা মত, রকমারী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণেরও অন্ত নেই। জাতি ও জাতীয়তা বিভিন্ন পর্যায়ে বিবর্তনের শিকার হয় অর্থাৎ এগুলো সর্বদা এক ও অভিন্ন থাকে না। অবিভক্ত উপমহাদেশে এবং সেই বৃটিশ যুগে ভারতীয় জাতীয়তার প্রবক্তা হলেও সেকালেই নজরুল বাঙালি জাতীয়তা এবং হিন্দু-মুসলিম জাতীয়তা সম্পর্কেও সম্যক সচেতন ছিলেন। তাই যে নজরুল অসংখ্য বার ভারতীয় জাতীয়তা ও জাগরণের গান গেয়েছেন, তাঁরই কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে ‘মোরা এক বৃন্তে দুইটি কুসুম, হিন্দু-মুসলমান, মুসলিম তার নয়ন মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ; কিংবা ‘হিন্দু-মুসলমান দু’টি ভাই, ভারতের দুই অাঁখি তারা, এক বাগানে দু’টি তরু, দেবদারু আর কদম চারা।’ ধর্ম যে জাতি গঠনে ও জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির এক বড় উৎস্য ও প্রেরণা, এ সত্য গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন বলেই ভারতীয় জাতীয়তা এবং হিন্দু-মুসলিম মিলনের প্রধান প্রবক্তা হয়েও জামাল উদ্দিন আফগানি ও আনোয়ার পাশা প্রমুখের প্যান-ইসলামিজমে উদ্বুদ্ধ নজরুল বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন, ‘ধর্মের পথে শহীদ যাহারা আমরা সেই সে জাতি’ সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি।
আমাদের এই বাংলাদেশটা যে একদা গোটা উপমহাদেশের সাথে বৃটিশদের অধীনস্থ ছিল এবং বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং ‘৪৭ সালের উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের এই দেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বিশেষত: মুসলিম বাংলার তরুণ যুব সম্প্রদায়ের যে একটা বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল, আমাদের বর্তমান প্রজন্ড তো দূরে কথা, আমরা তথাকথিত প্রবীণরাও যেন তা ভুলতে বসেছি। তাই বলতে চাই, কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব না হলে বাঙালি মুসলমানের জাতীয় পরিচিতি (National Identity) যে কোথায় হারিয়ে যেত। বিশেষত এদেশের ভাষা, সাহিত্য ও কালচারের ক্ষেত্রে তা নতুন করে ভেবে দেখবার সময় এসে গেছে। ইতিহাস চেতনার প্রয়োজনীয়তা এক্ষেত্রেই সবচাইতে বেশি। “History repeats itself”
নজরুল আবির্ভাবের পূর্বে ১৯ শতকের বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। নিদারুণ নিগৃহীত জীবনের ইতিহাস। শিক্ষাহীন, চাকরিবিহীন, ব্যবসায়বিহীন, মুটে, মাঝি, মিন্তি, কৃষক, ক্ষেতমজুর, মুসলমানদের তথাকথিত বাঙালি বাবুদের ক্রীতদাস, বড়জোর ইংরেজ সাহেবদের চাঁপরাসী হয়ে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকার মর্মন্তুদ প্রয়াস। নজরুল ‘ভোরের নকীব’ হয়ে জাগরণের আহবান জানিয়ে বললেন-
‘কোথা সে আজাদ কোথা সে পূর্ণ মুক্ত মুসলমান?’ আল্লাহ্ ছাড়া করে না কারো ভয় কোথা সেই প্রাণ?’ তিনি বাঙালি মুসলমানদের আত্মবিস্মৃতি, অসচেতনতা ও নিদ্রাচ্ছন্নতাকে চাবুক মেরে জাগিয়ে তুলে আসছিলেন;
‘ভুবনজয়ী তোরা কি হায় সেই মুসলমান,
খোদার রাহে আনলে যারা দুনিয়া না-ফরমান।
এশিয়া য়ুরোপ আফ্রিকাতে যাহাদের তকবীর
হুংকারিল (হাঁয়দারী হাঁক) উড়ল যাদের বিজয় নিশান।
কিংবা
‘দিকে দিকে পুনঃজ্বালিয়ে উঠিছে, দ্বীনই ইসলামী লাল মশাল,
ওরে বেখবর তুইও ওঠ জেগে, তুইও তোর প্রাণ প্রদীপ জাল।’’
নজরুল খরা জৈষ্ঠ্যে এসে ভরা ভাদরে চলে গেলেন। ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ (মুতাবেক ২৪ মে, ১৮৯৯) বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে এক হতদরিদ্র মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ড।১৩৮৩ সালের ১১ই ভাদ্র ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট স্বাধীন বাংলার রাজধানী ঢাকায় তাঁর মহাপ্রয়াণ। তাঁর জন্ডস্থান ও বাঙালি মুসলমান
১. উল্লেখ্য, ধূমকেতুর ১৯২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ‘পুজো’ সংখ্যার প্রকাশিত নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমন’ এবং ১৯২৮ (১৯২১) সালে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় চিরস্মরণীয় বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। এই সব জ্বালাময়ী লেখার জন্য কবি বৃটিশ শাসক গোষ্ঠীর রুদ্ররোধে পতিত ও কারারুদ্ধ হন। (ভবেশ রায়, শত মনীষীর কথা, পৃ: ৩০৫, অনুপম প্রকাশনী, ঢাকা-১১০০)
২. -করুণাময় গোস্বামী- নজরুল সংগীত : জনপ্রিয়তার স্বরূপ সন্ধান, পৃষ্ঠা-৩৭ বাংলা একাডেমী, ঢাকা (বা, এ ২৮৫৬) জুন ১৯৯৩… জীবনের যেন প্রতীকী রূপ। শুষ্ক, নিরস, দগ্ধীভূত বাঙালী মুসলমানের জীবনে নজরুল সরস বর্ষণ এনেছিলেন। অবিভক্ত বাংলার প্রবীণ ও প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ এবং আওয়ামী ঘরানার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী মরহুম আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯) লিখেছেন- এটা অবধারিত সত্য যে, কবি নজরুল জন্ডগ্রহণ না করলে অন্তত বাংলা ভাষী মুসলমান সমাজে আজিকার জয়যাত্রার অগ্রগতি থেকে কমপক্ষে এক শতাব্দি পিছিয়ে থাকতে বাধ্য হতো’। ভাগ্যাহত লাঞ্ছিত-বঞ্চিত, নিপীড়িত একটি জাতি যখন স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ঘরে বাইরে শশ্রুপরিবেষ্টিত, আধমরা, আড়ষ্ট এবং ম্রিয়মান, তখনই যুগস্রষ্টা এই সাহসী সন্তানকে ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ বলে যুগের নকীবের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এলেন। শিকল ভাঙার গান ও স্বাধীনতার গান শোনালেন, হিম্মৎ ও আশার ভাষা দিলেন। অস্তিত্ব রক্ষা নয়, শির উঁচু করে দাঁড়াবার প্রেরণা জোগালেন। সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করে একটি জাতিসত্তার ভিত গড়লেন। সেই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আজ বাংলাদেশ বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও কবি নজরুল এক ও অবিভাজ্য।
যে কবি আমাদের প্রেরণা। যার অবিনাশী গান, গজল, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, নাটক-নাটিকা, গল্প ও উপন্যাস আমাদের অন্ধকারে পথ দেখায়, হাঁটতে ফিরতে হেরার রশ্মির অনুপ্রেরণা যোগায়। অনাচার-অত্যাচার, জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে আহবান জানায়। ‘ভাঙার গান’ গেয়ে যিনি আবার গড়ার স্বপ্নে বিভোর করেন, তিনি তো জাতির আত্মার স্পন্দন, শরীরের তাগত, মনের শক্তি, জাতীয় কবির মর্যাদায় যাকে অধিষ্ঠিত করে আমরা গৌরবান্বিত। সেই মুসলিম রেনেসাঁর কবির যাদুকরী আহবান ও প্রেরণা থেকে বঞ্চিত ও বিভ্রান্ত হলে আমরা মনের অজান্তেই সমস্ত অর্জনকে বিসর্জন দিয়ে কাঙাল হয়ে দিগ্ভ্রান্ত হবো। যারা স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে কাঙাল হতে আগ্রহী কিংবা বাঙাল সেজে পরদুয়ারে ভিখমাগে তাদের কথা আলাদা। আমরা চাই জনম জনম ধরে কবিকীর্তির পরশ নিয়ে ধন্য হতে।
আমাদের স্মরণযোগ্য, ভারত উপমহাদেশ বিভাগ এবং বাংলার বিভক্তি ও নজরুলের কাম্য ছিল না, তিনি আজীবন হিন্দু-মুসলমানের মিলন ও সম্প্রীতি কামনা করেছেন। ঐক্যবদ্ধভাবে বৃটিশের বিরুদ্ধে তথা বিদেশী শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে আজীবন আপোষহীন সংগ্রাম করেছেন। ভারতীয় জাতীয়তাবোধ এবং স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হলেও নজরুল বাঙালী চেতনায়ও উদ্বুদ্ধ ছিলেন। যেমনি তিনি উদ্বুদ্ধ ছিলেন মুসলিম জাতীয়তাবোধে এবং ইসলামী চেতনায়। স্বদেশপ্রেমিক নজরুলের পক্ষেই তাই উচ্চারণ করা সম্ভব ছিল ‘কিছুতেই যেন ভুলিতে নারি, এ মাটির মায়ের মায়া/মোর ধ্যানে হেরি আল্লাহ্র পাশে, এই বাঙলার ছায়া।’ স্বদেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ-একথা মনে রাখলে স্বদেশ প্রেমিক নজরুল বক্তব্যের তাৎপর্য উপলব্ধি করা সহজ হবে। ‘বন্ধুরা এসো ফিরে’ শীর্ষক কবিতায় নজরুল বেদনাহত চিত্তে বলেছেন, ‘তোমরা বন্ধু কেহ অগ্রজ, অনুজ সোদর সম, প্রার্থনা করি ভাঙিয়া দিওনা মিলনে মম, এই সেতু আমি বাঁধিব, আমার সারা জীবনের সাধ; বন্ধুরা এস ভেঙ্গে দিব যত বিদেশীর বাধা বাঁধ (পাতা ফাঁদ)। কিন্তু বাস্তব অবস্থা এই দাঁড়ায় যে স্বতন্ত্র ইতিহাস ঐতিহ্য তথা জাতিসত্তার অধিকারী উপমহাদেশের হিন্দু ও মুসলিম এই দুই প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়; শেষ পর্যন্ত সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনৈক্যের দরুন ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়। একইভাবে বসু-সোহ্রাওয়ার্দীর যুক্ত বাংলা তথা বৃহৎ বাংলার পরিকল্পনা, মুসলিম লীগ হাই কমান্ড জিন্নাহ্র সম্মতি সত্ত্বেও কৃপালনী-প্যাটেল ও গান্ধী-নেহরুর ন্যায় শীর্ষ হিন্দু নেতৃবর্গের আপোষহীন অনমনীয়তায় ১৯০৫ সালে কথিত বঙ্গজননী বাংলাবিভক্ত হয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে ‘কীটদষ্ট দ্বিখন্ডিত পাকিস্তান’ রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়- যা থেকে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
১৯৪১ সালে ‘আমার লীগ কংগ্রেস’ শীর্ষক দৈনিক নবযুগের এক সম্পাদকীয় তথা আত্মউম্মোচনমূলক নিবন্ধে নজরুল বলেন যে, তিনি কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের দুই আনার সদস্য না থাকলেও উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এবং মুসলিম জাগরণমূলক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ও অবদান সমকালীন যে কোন নেতার চেয়ে কম নয়। মুসলিম বাংলার অবিসংবাদিত শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের সাথে কবি নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠতা ও মাধুর্যতার কথা জানা যায়।
বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বহুকাল আগে বৃটিশ শাসনের শেষভাগে ১৯৪২ সালের মাঝামাঝি নজরুল অসুস্থ ও বাকশক্তিহীন হয়ে গেলেও নজরুলের কবিতা, গান ও অন্যান্য রচনা এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণার উৎস হয়েছে। একদা নজরুল ‘পূর্ববঙ্গ’ শীর্ষক কবিতায় এবং ‘বাংগালীর বাংলা’ নামাংকিত নিবন্ধে যথাক্রমে পূর্ববংগের নবজাগরণ তথা সুপ্ত চেতনার উত্থান অনুধাবন ও কামনা করেছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন, ‘যত পরদেশী দস্যু, ডাকাত/ ‘রামাদের’, ‘বামাদের’ বাংলাদেশ থেকে’ তাড়াবেন। বস্তুত: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমা অবাঙালী শাসক শোষকদের পরাজয়ে এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে এ স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন ঘটেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। এদিক থেকে মূল্যায়ন করলেও নজরুল কেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি তা অনুধাবন করা সহজ হবে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে (১) ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট’ (২) ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ (৩) ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়েও খাটি আমার দেশের মাটি’-এমনি অন্যুন ২০টি দেশাত্মবোধক সংগীত স্বাধীনতাকামী ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অনুপ্রাণীত করেছিল। সপ্রতি বঙ্গ বীর কাদের সিদ্দিকী যথার্থই লিখেছেন, ‘বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি আমাদের গভীর দায়বদ্ধতা আছে। ঢাকার মাটিতে কবর দিয়েই আমরা সে দায়বদ্ধতা সারতে পারি না। — কবি গুরু রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে যেমন বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি বিশেষ করে বাঙালির জাতিসত্তার কথা ভাবা যায় না, ঠিক তেমনি কাজী নজরুল ইসলামকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা চিন্তা করা দিবা স্বপ্নের মতো। রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধাদের প্রেরণার প্রধান উৎসই ছিল কাজী নজরুল। নজরুলের বিপ্লবী সংগীত সমূহ (শিকল পরা ছল, বলবীর, —– উন্নত মমশীর, ইত্যাদি) আমাদেরকে সিংহের তেজে তাড়িত করেছে। ১৯৮২-৮৩ সালে কবির জন্ডস্থান দেখার প্রবল সদিচ্ছা নিয়ে ৫/৬আ জনের এক বাহিনীসহ বাঘা সিদ্দিকী বলে কথিত এই অবিসংবাদিত মুক্তিযোদ্ধা বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া ভ্রমণে গিয়ে আরো লিখেছেন, ‘স্বাধীনতার পর ভারতীয় মুসলমানেরা আমাদের উপর খুব একটা খুশী ছিলনা —– তবে বর্ধমান জেলার আসানসোলে কবি বাড়িতে গিয়ে ভীষণ আন্তরিকতা ও আতিথেয়তা পেয়েছিলেন। কবিপত্নী প্রমীলা দেবীর (১৯০৫-৬২) কবর (স্থানীয়) নজরুল একাডেমীর সামনে। পাশে কবি নজরুলের জন্য কবরের একটি চিহ্ন রাখা হয়েছিল। যদিও তাঁর কবর হয় স্বাধীন বাংলার রাজধানী ঢাকায়।
নজরুল শুধু বাংলাদেশের ভৌগোলিক রূপ প্রকৃতি এবং নৈসর্গিক সৌন্দর্য মহিমার অনন্য সাধারণ রূপকারই নন, তিনি এখানকার জনতার, দু’প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর মানসচেতনা এবং জাতীয়তাবোধের ও অসামান্য রূপকার। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং শ্রেণীগত অবস্থানের নিরীখে দেখলেও লক্ষ্য করা যাবে যে, বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগণ তথা দারিদ্র্যপীড়িত, শোষিত বঞ্চিত মানুষ নজরুলের কবিতা, গান ও অন্যান্য রচনায় বিচিত্ররূপে বিধৃত হয়ে আছে। এদেশবাসীর জাতীয় আত্মপরিচয়, মানসচেতনা, জনজীবন, জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রাম সাধনার কথা নজরুল সাহিত্যে অনবদ্যরূপে ও অনুপ্রেরণা সঞ্চারীরূপে প্রতিভাত হয়ে আছে বলেই তিনি জাতীয় কবিরূপে জনহৃদয়ে অভিষিক্ত, মানস-মন্দিরে পূজ্য তথা স্মরণীয়। আজও সকল সংকটে সামগ্রিকভাবে ‘যাবতীয় দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার/ লংঘিতে হবে রাত্রি নিশিথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার/ অসহায় জাতি মরিয়াছে ডুবিয়া জানে সন্তরণ/ কান্ডারী আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিমন, হিন্দু না ওরা মুসলিম, ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী বল, ডুবিছে মানুষসন্তান মোর মার।’’ উল্লেখ্য, ১৯২৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় কবি কর্তৃক সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক অনুষ্ঠানে পরিবেশিত ও তাঁর অতিখ্যাত ‘চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ গানটিকে বাংলাদেশ সরকার রণসংগীতের মর্যাদা দান করেছে।
কবিকে সম্মাননা প্রদান:
১৯৭২ সালের ২৪ মে কবির ৭৩তম জন্ডদিনে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে অসুস্থ কবিকে সপরিবারে স্বাধীন বাংলাদেশে আনা হয়। স্বাধীনতার স্থপতি, তৎকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের উদ্যোগে। ১৯৪২ সালের জুলাই থেকে ১৯৭৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৪টি বছর কবির অসহনীয় ও কর্মহীন নির্বাক জীবনকাল অতিবাহিত হয়। তাহলে বলা যায় ১৯২০ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত বড়জোর ২২/২৩ বছর মাত্র এই বাউন্ডেলে, ছন্নছাড়া, বাঁধনহারা, দারিদ্র্যক্লিষ্ট ও শোকার্ত কবির সৃষ্টিকালীন কর্মজীবন। বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির অমর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ সমাবর্তনে জাতীয় কবিকে সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ১৯৬০ সালে ভারত সরকার কবিকে ‘পদ্মভূষণ’ ও ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধি প্রদান করেছিল। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারী মাসে কবিকে বাংলাদেশ সরকার নাগরিকত্ব প্রদান এবং ‘একুশে ফেব্রুয়ারী একুশে পদকে ভূষিত করে। ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/ যেন গোর থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের উত্তর পাশে জাতীয় কবির মাজার কবির সেই সদিচ্ছারই (অসিয়ত) বাস্তবায়ন। আমরা এজন্য গৌরবান্বিত বোধ করছি।
জাতীয় জাগরণের দুই পথিকৃৎ: শেরে বাংলা ও নজরুল প্রসংগ
বাংলার মুসলিম রেনেসাঁর কবি কাজী নজরুল ইসলামকে, ‘মুসলিম বাংলার জনক’ ও উপমহাদেশের অন্যতম সেরা মুজাহিদ শের-ই-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২) স্বীয় সন্তানের ন্যায় স্নেহ করতেন। নজরুলের কর্মময় জীবনে (১৯২০-৪২) তাঁর সাহিত্য ও সংগীত চর্চায় তিনি সম্ভাব্য সবরকম পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। সংগত কারণেই এখানে তার বিশদ আলোচনা করা সম্ভব নয়। বিদ্রোহী কবির প্রতি কতটা আস্থাপ্রীতি থাকলে শের-ই-বাংলা এরূপ উক্তি করেছেন যে, ‘আমি যদি কাজী নজরুল আর আববাস উদ্দিনকে নিয়ে বাংলাদেশ ভ্রমণে বের হই, তাহলে সারা বাংলা জয় করতে পারি মাত্র ক’দিনের ভিতরেই।’
১৯২০ সনের ২০ জুলাই অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কলকাতা হাইকোর্টের স্বনামধন্য ও অপ্রতিদ্বনদ্বী আইনজীবী এ. কে. ফজলুল হকের পৃষ্ঠপোষকতায় সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশিত হলে সদ্য সেনাবাহিনী থেকে প্রত্যাগত একুশ বছরের টগবগে তরুণ হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলামের সাংবাদিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। ১৯২৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর নজরুলের সম্পাদনায় বাংলা ভাষায় শ্রমিক-কৃষক-স্বরাজ দলের মুখপত্র প্রথম সাপ্তাহিক ‘লাঙ্গল’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, ১৯২০ সালে ৪৯ নং বাঙালী পল্টন বিলুপ্ত হলে করাচী ফেরত নজরুল কলকাতার বাবু শ্রেণীর নিকট মুসলমান হবার অপরাধে হিন্দু মেসে আশ্রয় না পেয়ে বংগীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সাদর সংবর্ধনা পান। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড মুজাফফর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, কাজী আবদুল ওয়াদুদ প্রমুখ সাহিত্যিক সাংবাদিকদের দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হন। বলাবাহুল্য, কৈশোরে অনেকটা পারিবারিক পরিবেশে ইসলাম ও কর্মজীবনের শুরুতে সাম্যবাদী দর্শনে আকৃষ্ট হলে নজরুল সাহিত্যে নানাভাবে এর প্রভাব বিধৃত হয়েছে।
১৯৩৭ সালের ১০ জানুয়ারি কলকাতা ধর্মতলার ওয়াসেক মোল্লা ম্যানসনে ঈদ-প্রীতি সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে ফজলুল হক ও কাজী নজরুলের মধ্যে এক হৃদ্যতাপূর্ণ সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়। ঐ বছর ৭ মে প্রথম হক মন্ত্রিসভার (১৯৩৭-৪১) সমর্থনে কলকাতা এলবার্ট হলে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪০ সালের জানুয়ারি মাসে পুনঃ কাজী নজরুলকে প্রধান সম্পাদক করে দৈনিক নবযুগ পুনঃপ্রকাশিত হয়। কিন্তু ১৯৪২ সালে কাজী নজরুল অসুস্থ হলে ফজলুল হক সাহেবের অনুরোধক্রমে তাঁর ২য় মন্ত্রিসভার (১৯৪১-৪৩) প্রভাবশালী সদস্য ডা. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী কবিকে দেখতে যান এবং ডা. বিধান চন্দ্র রায়কে দিয়ে কবির চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু দেশ-বিদেশের সকল চিকিৎসকই ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। বিদ্রোহী কবির জন্য ফজলুল হক তাঁর সরকারের অধীনে সংগীত বিভাগ চালু করেন। কিন্তু কবি নজরুল ইসলাম সরকারী চাকরি গ্রহণ না করে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হক সাহেবের কাছে ‘শান্তি নিকেতনে’র মতো একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রস্তাব করেন। সেকালে শের-ই-বাংলার জন্য এটা কোন কঠিন ব্যাপারই ছিলনা। কিন্তু কবি নজরুল আরোগ্য লাভ না করায় নতুন কোন গুরুদায়িত্বভার তো দূরের কথা, দৈনিক নবযুগের সম্পাদকের দায়িত্ব জনাব আবুল মুনসুর আহমদ ও মাওলানা আহমেদ আলীর উপর বর্তায়। বরিশালের সাহিত্যিক ও গবেষক কবি এ.কে. জয়নুল আবেদীন (১৯২০-৮০) ‘আতোশবাজ’ ছদ্মনামে দৈনিক নবযুগের ‘আগুনের ফুলকি’ শিরোনামে শিশু বিভাগের পরিচালক ছিলেন। কবি নজরুলের গুরুতর অসুস্থতাজনিত কারণে একে ফজলুল হকের অনুমতিক্রমে তিনি ও মরহুম কবি জয়নুল আবেদীন কিছুদিন দৈনিক নবযুগের সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি ‘ছোটদের ফজলুল হক’ ও “Memorable Speeches of Sher-e-Bangla’ এসব গ্রন্থ প্রণয়ন ও প্রকাশনা করেন।
০ সাংবাদিক হিসেবে : এক্ষেত্রে কবি নজরুলের সম্যক ভূমিকা বিশ্লেষণের উদ্দেশ্য নয়
দৈনিক নবযুগের সম্পাদক হিসেবে নজরুলের বক্তব্য অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। স্থানাভাবে এখানে সামান্য উদ্ধৃতি দিতে চাই- ‘আমি নবযুগে যোগদান করেছি শুধু ভারতে নয়, জগতে নবযুগ আনার জন্য। এ আমার অহংকার নয় এ আমার সাধ, এ আমার সাধনা। এই বিদ্বেষ, কলহ কলংকিত, প্রেমহীন, ক্ষমাহীন, অসুন্দর পৃথিবীটা সুন্দর করতে, শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে, আল্লাহর বান্দাহ রূপেই কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছি। ইসলাম ধর্ম এসেছে পৃথিবীতে পূর্ণ শান্তিসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে। কোরআন মাজীদে এই মহাবাণীই উত্থিত হয়েছে। আমার কবিতা যারা পড়েছেন তারাই সাক্ষী আমি মুসলমানকে সংঘবদ্ধ করার জন্য, তাদের জড়ত্ব, আলস্য, কর্ম বিমুখতা, ক্লৈব্য, অবিশ্বাস দূর করার জন্য আজীবন চেষ্টা করছি। বাঙলার মুসলমানকে শির উঁচু করে দাঁড়াবার জন্য, যে শির এক আল্লাহ ছাড়া কোন সম্রাটের কাছেও নত হয়নি। আল্লাহ আমাকে যতটুকু শক্তি দিয়েছে তাই দিয়ে বলছি, লিখছি ও নিজের জীবন দিয়েও তার সাধনা করেছি। আমার কাব্য শক্তিকে তথাকথিত ‘খাট’ করেও গ্রামোফোন রেকর্ডে শত শত ইসলামী গান রেকর্ড করে নিরক্ষর তিনকোটি মুসলমানের ঈমান অটুট রাখারই চেষ্টা করেছি। বাঙলার মুসলমান বাংলার অর্ধেক অংগ। কিন্তু এই অংগ আলস্যে জড়তায় পঙ্গু। এই ছত্রভংগ ছিন্নদল মুসলমানদের আবার এক আকাশের ছত্রতলে, এক ঈদগাহের ময়দানে সমবেত করার জন্যই আমি চিরদিন আজান দিয়ে এসেছি। মানুষ মাত্রই আল্লাহর খলিফা-আল্লাহর সৈনিক। অসুন্দর পৃথিবীকে সুন্দর করতে সর্ব নির্যাতন সব অশান্তি থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করতে আমার জন্ড। আমি সেই কথাই আজীবন বলে যাব, লিখে যাব, গেয়ে যাব — যারা এই পৃথিবীতে নিজেদের রাজত্বের দাবী করে তারা শয়তান। সে শয়তানদের সংহার করে আমরা আল্লাহর রাজ প্রতিষ্ঠা করব।’’ (ইনশা আল্লাহ) ঢাকা, কলকাতা ছাড়াও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর, কুমিল্লা , কুষ্টিয়া প্রভৃতি স্থানে ১৯২৮ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে প্রদত্ত কবি নজরুলের অভিভাষণ সমূহ বর্তমান প্রজন্ডের জন্য দারুন শিক্ষাপ্রদ ও উৎসাহব্যঞ্জক বৈকি।
১৩৪৭ সালের ৮ পৌষ সৌজন্য সংখ্যা দৈনিক ‘কৃষাণে’ ‘আল্লাহর পথে আত্মসমর্পণ’ শীর্ষক অভিভাষণেও বাংলার মুসলিম যুবকদের করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে কাজী নজরুল ইসলাম অনেক মূল্যবান বক্তব্য রেখেছেন। ‘লিডারের কাছে শক্তি ভিক্ষা করনা- শক্তি ভিক্ষা করো একমাত্র আল্লাহর কাছে। জয়ধ্বনি মহিমা কীর্তন কর একমাত্র আল্লাহর। ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়াআ ওয়ামামাতি লিল্লাহি রাবিবল আ’লামিন’’, পবিত্র কোরআন থেকে উক্ত মহামন্ত্রের উদ্ধৃতি ও অভিভাষণের শেষে কবির উন্ডুক্ত আহবান- ‘ভেঙেছে দুয়ার জেগেছে জোয়ার রেঙেছে পূর্বাচল, খুলে গেছে দেখ দুর্গতি ভরা দুর্গের অগল। মৃত্যুর মাঝে অমৃত যিনি এনেছে ‘তাঁহার বাণী’, পেয়েছি তাঁহার পরমাশ্রয়, আর ভয় নাহি মানি। সকল ভয়ের মাঝে বাজে যাঁর পরম অভয় কোল সেই কোলে যেতে আয়রে কে দিবি মরণ দোলাতে দোল।’’
কবি নজরুলই বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি, যিনি সাংবাদিকতা ও রাজনীতিকে সাহিত্য ও কাব্যের প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন। সাহিত্য ও কাব্য যে যুদ্ধ মারণাস্ত্রের মত অমোঘ হতে পারে এবং জাতীয় দুর্দিনে জাতি যে তা ঢালের মতো ব্যবহারপূর্বক একই সংগে আত্মরক্ষা করতে এবং শত্রুহৃদয়ে আতংক সৃষ্টি করে তাদের পশ্চাদপসারণে আল্লাহর আশীর্বাদ হতে পারে, তার তুলনাবিহীন উদাহরণ তিনি। শত্রুর হৃদয়ে আতংক সঞ্চারণে তাঁর সমান কবি যে বাংলা সাহিত্য একজনও নেই, দ্বিধাহীন চিত্তে গর্বিতভাবে সেকথা যে কোন বাঙালী পাঠক বলতে পারেন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম যুগ সৃষ্টি করেছিলেন সত্য; কিন্তু যুগও তাঁকে সৃষ্টি করেছিল। কারাবন্দী স্বদেশবাসীর ক্রন্দসী আত্মার আর্তনাদে তাঁর হৃদয় ব্যথিত হয়েছিল বলে উন্ডত্ত শক্তি ভর করেছিল তাঁর মসিতে। ফলে খয়বর জয়ী আলীর মত খয়বরের দুর্গ কপাট ভাঙবার দু:সাহস তিনি দিতে পেরেছিলেন গোটা উপমহাদেশের জাতিকে।
০ আমাদের জাতিসত্তার নিরিখে নজরুলের পুনর্মূল্যায়ন
নজরুলকে নিয়ে একদল অতি উৎসাহী, অন্যদল নিরুৎসাহী। একদল এড়াতে চান, অপর পক্ষ খন্ডিত নজরুলকে উপস্থাপন করে তুষ্টি পান। কিছু অনুরাগীর চোখে নজরুল একজন চারণকবি, কারো দৃষ্টিতে বিদ্রোহী কবি, কেউ ভাবেন তিনি গান-গজলের কবি, কারো কারো মূল্যায়ন- নজরুল সময়ের কবি, ঝড়ের বেগে এলেন, ঝাড়োগতিতে বিদায় নিলেন। কোন কোন সমালোচকের দৃষ্টিতে, নজরুল প্রেম ও সাম্যের কবি। নজরুল সাহিত্যের ভক্ত অনুরক্ত যেমন প্রচুর, তেমনি নিন্দুকেরও শেষ নেই। ভক্তরা আবার দল বিভক্ত, খন্ড খন্ড করে নজরুল চর্চায় তাদের উৎসাহ বেশি। নিন্দুকেরা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, তাঁরা নিন্দার ভাষায় হেরফের করেন বটে, কিন্তু লক্ষ্যচ্যুত হননা। তাঁদের ভাবনা- নজরুলকে খন্ডিত করা হোক, আর অখন্ডই রাখা হউক, তার ভিতর যে মুসলমানিত্ব ভর করেছে সেটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। প্রকৃত পক্ষে, শৈশবে মক্তব জীবন থেকে প্রৌঢ়ে মসজিদের পাশে কবর পাবার আকুতি, রেনেসাঁর জন্য জেহাদ, সব মিলে আগাগোড়া নজরুল একজন সাচ্চা বাঙালী মুসলমান। তাঁর মুসলমানিত্বে খাদ ও নিখাদ এর মাত্রাজ্ঞান বিবেচ্য নয়। আসল বিবেচ্য প্রসংগ তাঁর লক্ষ্যমাত্রা। এখানে শুধু ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসই’ নয়, একটি জাতির জাগ্রত জাতিসত্তার ভেতর ‘আধমরাদের ঘা দিয়ে জাগিয়ে’ দেবার বাসনাটিই মুখ্য। সে জাতি কখনো বাঙালি মুসলমান কখনো মুসলিম উম্মাহ কখনো ভারতীয় কিংবা বাঙালি। জনৈক গবেষকের ধারণা, ভক্তদের খন্ডিত নজরুলের চেয়ে নিন্দুকদের অখন্ড নজরুল বাস্তবতার কাছাকাছি এবং প্রকৃত নজরুলকে প্রতিনিধিত্ব করে।
এ প্রসঙ্গে শেষ কথা না হলেও সহজ কথা, নিন্দুক সমালোচকরা তাদের অসৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে খতিয়ে খতিয়ে নজরুলের বহুমাত্রিকতা তুলে ধরেছে। এই বহুমাত্রিকতার ভেতর একজন কালোত্তীর্ণ ও সমৃদ্ধ নজরুলকে খুঁজে পাওয়া যত সহজ, ভক্তদের প্রেমের কবি কিংবা রোমান্টিক কবি, সাম্যের কবি, মানুষের কবি, বিদ্রোহী কবি প্রভৃতি বিভাজনের ভেতর তত সহজ নয়। প্রখ্যাত নজরুল গবেষক শফি চাকলাদার দু:খ করে লিখেছেন, জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের পূর্ণাংগ জীবনী গ্রন্থ এখনো প্রণীত ও প্রকাশিত হয়নি (কাজী নজরুল ইসলাম প্রসংগ। পৃ: ৩৩৬/২০০৩)
উপসংহার: জাতিসত্তার নিরিখে আমরা আজ ম্রিয়মান, মৃতপ্রায় দুর্বল এক জাতিতে পরিণত হয়েছি। এ দুরবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করে ‘শির উঁচু’ করে দাঁড়াবার শক্তি যোগাতে পারে একমাত্র নজরুলেরই গান-গজল, কাব্য ও গদ্য-সাহিত্য। কবির অসংখ্য গান, কবিতা, প্রবন্ধ, ভাষণ-অভিভাষণ বৃটিশ শাসন ও শোষণের সময় জাতিকে যেভাবে উজ্জীবিত করেছে; আজও সেই গান ও কবিতাই জাতির জন্য শক্তি ও সাহস। কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য, ষড়যন্ত্রের কালো হাত সেই কবিকে আড়াল করেছে আমাদের জাতীয় জীবন থেকে আমাদের নতুন প্রজন্ডকে ও নজরুলের যথার্থ পরিচয় থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বি এ অনার্স ও এম এ পর্যায়ের পাঠ্যসূচিতে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের সাহিত্য সুকৌশলে ও মর্মন্তুদভাবে উপেক্ষিত। বিষয়টি নিয়ে নজরুল গবেষক শেখ দরবার আলেম তাঁর গ্রন্থেও বিভিন্ন প্রতিবেদনে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫ বিটিভিএর ‘কথামালা’ অনুষ্ঠানে বিষয়টি সম্পর্কে পুনঃআলোচনা করেন। ‘কিন্তু কোথায় যেন একটি ‘কিন্তু’ রয়ে গেছে, তাই সকলি গরল বেল।’ বর্তমান মহাজোট সরকারের প্রধান দলপতি ও সাবেক রাষ্ট্রপতির ভাষায়- ‘‘এ দেশ, এ জাতি, এই জাতীয় পতাকা, আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব আমাদের কাছে যেমন প্রিয়, তেমনি জাতীয় কবি নজরুল আমাদের কাছে প্রিয়। নজরুল প্রতিভার উপলব্ধির ক্ষেত্রে আমাদের দেশের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর অনীহা, বোধের দীনতা শুধুই ধিক্কারের যোগ্য। ঐ সব তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের জেনে রাখা উচিত সেই রবীন্দ্র যুগে ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার এলবার্ট হলে বাঙালিদের পক্ষ থেকে কবি নজরুল জাতীয় কবির দুর্লভ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শেরেবাংলা এ.কে ফজলুল হকের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আচার্য স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, ব্যারিস্টার এস. ওয়াজেদ আলী প্রমুখ ঐ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নজরুলের উপর প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য রেখেছিলেন। অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খানের ভাষায় ‘নজরুল আমাদের অহংকার, আমাদের বড় আদরের ধন, সংকট জয়ের দুর্বার প্রেরণা, সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ঘষেটি বেগম, মীর জাফরদের ত্রাস, হঠকারী ও নতজানু শাসকদের জন্য এক জ্বলন্ত অঙ্গার, যে অঙ্গারের আগুনে পুড়ে তারা একদিন ছারখার হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।’’
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর কাজী নজরুলকে জনগণ জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করলেও এ দেশের একশ্রেণীর মুখচেনা মুষ্টিমেয় কয়েকজন পরগাছা বুদ্ধিজীবী তাঁর সমালোচনা অব্যাহত রাখছেন সুকৌশলে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে ‘ভারতীয় সংস্কৃতি ভবন’-এর তত্ত্বাবধানে ‘ভারত বাংলাদেশ শিক্ষা সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদ’ গঠিত হয়। এদেশে শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য নষ্ট করে উভয়বঙ্গের শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সমভাবে ‘ভারতীয়করণের’ জন্য এই সংগঠনের সৃষ্টি। সংগঠনটির প্রথম পর্যায় এ দেশের যে তেরজন বুদ্ধিজীবী জড়িত ছিলেন আজও তাঁরা সুদৃঢ়ভাবেই নিজেদের ভূমিকা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। এ দেশের শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি শক্তহাতে ও সুনিপুণভাবে নিয়ন্ত্রণের মূল লক্ষ্য কি তা বোধকরি এ দেশের দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের আর ব্যাখ্যা করার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের স্কুল, কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে নজরুলের সমসাময়িক কবি আশরাফ আলী খান (১৯০১-৩৯), গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪), তাঁর সার্থক উত্তরসূরী কবি ফররুখ আহমদ (১৯১৮-৭৪), কবি তালিম হোসেন (১৯১৮-২০০৫) প্রমুখের বিশেষ করে জাতীয় কবির কবিতা তথা সাহিত্য পাঠ্যসূচি থেকে বর্জন কিংবা নিয়ন্ত্রণের মূল কারণ নজরুলের ইসলামী কবিতাও প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা ইসলামী গীতি সম্ভার। অথচ নজরুল যদি চিরায়ত তথা যুগে যুগে রেনেসাঁ সৃষ্টিকারী কিছু স্পষ্ট করে থাকেন, তবে তা নিঃসন্দেহে তাঁর ইসলামী কাব্য ও গীতি সম্ভার বরং কেউ কেউ মনে করেন, কবি নজরুলের চেয়ে সঙ্গীত সম্রাট নজরুলের শ্রেষ্ঠত্ব ও স্থায়িত্ব আরো বেশি। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও আধিপত্যবাদী শক্তির এজেন্টদের শত বিরোধিতার মধ্যে তখনো যেমন নজরুল বেঁচেছিলেন, ভবিষ্যতেও তেমনি থাকবেন। সেদিন বেশি দূরে নয়, নজরুল প্রেমিক ও স্বদেশপ্রেমিক বাংলাদেশের মানুষ দেশের স্বার্থে, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের স্বার্থে নজরুলের বাণী চিরন্তনীর আহবানে সাড়া দিয়ে ‘শক্তি সিন্ধু’ মাঝে অবগাহন করে শির উঁচু করে দাঁড়াবে, ইনশাআল্লাহ। কাজী নজরুল ইসলাম শুধু আমাদের জাতীয় কবি নন, তিনি বিশ্বকবি। তিনি শুধু একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেননি, তিনি বিশ্বব্যাপী শোষণহীন শান্তিপূর্ণ সমাজ তথা বিশ্ব বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছেন। এ স্বপ্নের বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অপাতত: বাংলাদেশের তরুনদেরকে উজ্জীবিত হবার আহবান রাখছি, নজরুলেরই ভাষায় ‘নিত্য সজীব যৌবন যার, এসো এসো সেই নৌ-জোয়ান/ সবর্বক্লৈব্য করিয়াছে দূর, তোমাদেরই সেই চির আত্মদান/ ওরা কাদা ছুঁড়ে বাধা দেবে ভাবে-ওদের অস্ত্র নিন্দাবাদ/ মোরা ফুল ছুঁড়ে মারিব ওদের, বলিব, ‘আল্লাহ জিন্দাবাদ’/ বক্ষে আগুন আছে তোমাদের, তোমরা অগ্নিগিরি/ সে অগ্নিশিখায় ভীষণ আত্মবিস্মৃতি আছে ঘিরি/ পাষাণ হইয়া পড়ে আছো আজ হায়রে আত্মভোলা/ তোমরা জাগিলে সারা পৃথিবীতে জাগিবে প্রবল দোলা।’

লেখক;কলামিষ্ট ও গবেষক।