আজ থেকে প্রায় এক বছর আগে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে আমরা ফিরে যাই ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই। দিনটি সিলেটের সাংবাদিকদের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এ দিনে পেশাগত দায়িত্ব পালনে অবিচল থেকে সত্যকে তুলে আনার সংগ্রামে প্রাণ দিয়েছেন সিলেটের অকুতোভয় সাংবাদিক শহীদ এটিএম তুরাব। দেখতে দেখতে একটি বছর পেরিয়ে গেছে। সাংবাদিক এটিএম তুরাবের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতে আমরা তাকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। ফিরে দেখা সংবাদ মাধ্যম থেকে জানামতে গত বছর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই বাদ জু্ম্মা পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য নগরের কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় অবস্থান করছিলেন সিলেট প্রেসক্লাব সদস্য, স্থানীয় দৈনিক জালালাবাদের ফটো সাংবাদিক এটিএম তুরাব। নামাজ শেষে তুরাব সহ অন্যান্য সহকর্মী সাংবাদিকেরা দেখতে পান বিএনপির একটি মিছিল আসছে তখন তুরাব স্থিরচিত্র ও ভিডিওগ্রাফি করছিলেন। মিছিলটি পুরানলেন গলির মুখে পৌঁছার পর সশস্ত্র পুলিশ পেছন দিক থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে অনেকে গুলিবিদ্ধ হন এবং ছবি তুলতে থাকা এটিএম তুরাবও গুলিবিদ্ধ হন। প্রসঙ্গত, পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ইংরেজিতে বড় অক্ষরে প্রেস লেখা বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ছিল তুরাবের গায়ে । তা সত্ত্বেও পুলিশ সাংবাদিকের দিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছে।
গুলিবিদ্ধ তুরাব চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেলে অন্য সহকর্মীরা তাকে দ্রুত সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় এবং তার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার শঙ্কায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে নগরের সোবহানীঘাট এলাকায় অবস্থিত ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় সন্ধ্যা ৬টা ৪৪ মিনিটে তাঁর মৃত্যু হয়। পুলিশের গুলিতে নিহত সাংবাদিক এটিএম তুরাবের ময়না তদন্ত, জানাজা ও দাফনকে কেন্দ্র করে ছিল উত্তেজনা। বিক্ষোভ কর্মসূচির প্রস্তুতি ছিল, তবে শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। কারফিউ, সেনা মোতায়েন, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে সাধারণ মানুষের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছিল। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা।
দুপুর ১২টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হলে নগরের বিভিন্ন বাজারে লোক সমাগম বাড়ে। তবে সকাল থেকে সিলেটে কোন বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল না। আগের দিন (১৯ জুলাই) পুলিশের গুলিতে নিহত সাংবাদিক এটিএম তুরাবের মরদেহ সে দিন সকালে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়না তদন্ত করা হয়। ময়না তদন্তের আগে সুরতহাল প্রতিবেদনে পুলিশ গুলির ঘটনা এড়িয়ে যায়। এ নিয়ে ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে সাংবাদিকদের সঙ্গে পুলিশের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। পরে, গুলির বিষয়টি নিশ্চিত করে ময়না তদন্ত করা হয়। সাংবাদিক তুরাবের শরীরে ৯৮টি ছররা গুলির চিহ্ন থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক। ময়না তদন্ত শেষে সহকর্মী সাংবাদিক বিজনেস বাংলাদেশ সিলেট জেলা প্রতিনিধির রেজাউল চৌধুরী ভাইয়ের মোটর বাইকে চড়ে সহকর্মী সাংবাদিক সরকার নিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোষ্টের সিলেট প্রতিনিধি মাসুদ আহমদ রনি ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল জনতার ডাক ২৪ ডটকমের সম্পাদক মোহাম্মদ জসিম ভাই সহ তুরাবের মরদেহ বেলা দুইটায় নগরের মানিকপীর টিলা কবরস্থান সংলগ্ন প্রাঙ্গণে জানাজার জন্য নিয়ে আসা হলে সেখানে এক হৃদয় বিদারক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। মানিক পীরের টিলায় আগে থেকেই সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক আলোকিত সিলেটের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক প্রিয় ভাই মোহাম্মদ গোলজার আহমদ হেলাল বেলা ১২টা থেকে উপস্থিত থেকে নিয়মিত মুঠোফোনে খবর রেখেছেন আমার সাথে। তুরাাবের মরদেহ যখন আনা হল নগরীর মানিকপীর টিলায় শতশত সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ। জানাজায় সিলেটের কয়েক শতাধিক সংবাদকর্মী অংশ নেন। মরদেহ নেওয়া হয় নিজ প্রতিষ্ঠান সিলেট প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে। সেখানেও সহকর্মী সাংবাদিকদের সাথে আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে উপস্থিত সংক্ষিপ্ত সমাবেশ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। তারপর দাফনের জন্য গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান সাংবাদিক তুরাবের পরিবারের সদস্য সাংবাদিক তুরাবের বড় ভাই আবু আজরফ জাবুর তুরাবের মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি বিয়ানীবাজার পৌরসভার ফতেহপুর গ্রামে নিয়ে গেলে সেখানে আবারও জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
তুরাব শহীদ হওয়ার পর সহকর্মী সাংবাদিকেরা খুনীদের বিচারের দাবীতে আন্দোলন করি।সিলেটে কর্মরত সাংবাদিকরা কারফিউ, ১৪৪ ধারা ভায়োলেন্স করে ঝুঁকি নিয়ে সমাবেশ করে।সিলেট প্রেসক্লাব,সিলেট জেলা প্রেসক্লাব ও সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাব সহ ৭টি সাংবাদিক সংগঠন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করেছে। দ্রুত সময়ে আমরা শহীদ সাংবাদিক তুরাবের খুনীদের বিচার চাই, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। আল্লাহ তুরাবকে জান্নাতের সুউচ্চ মর্যাদা দান করুন আমীন।
লেখক:সাংবাদিক।