তদন্তে নেমেছে দুদক এবার অগ্রণী ব্যাংকে জালিয়াতির আলামত

প্রকাশিত: ৯:০৫ পূর্বাহ্ণ, |                          

দৈনন্দিন ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনায় জার্মান কোম্পানি টেমিনসের সফটওয়্যার (কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার টি-২৪) ব্যবহার করে অগ্রনী ব্যাংক লিমিটেড। টেমিনসের পক্ষে লোকাল এজেন্ট হিসেবে চুক্তি ও সফটওয়্যারের যাবতীয় সেবা দিয়ে থাকে ঢাকার কোম্পানি ফ্লোরা টেলিকম লিমিটেড। কিন্তু সফটওয়্যার আফগ্রেড কিংবা রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ না করেই কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে ফ্লোরা টেলিকম।
বাজার দর থেকে তিনগুন বেশি ফি আদায়, সেবা না দিয়ে বিল নেয়া, অর্থ পাচার- সবি করেছে ফ্লোরা টেলিকম। কোম্পানিটি অগ্রনী ব্যাংকের থেকে যে টাকা পায় তা আবার কমিয়ে দেখায় চুক্তির প্রকৃত অংশীদার টেমিনসকে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে সফটওয়্যার চুক্তির আড়ালে অগ্রনী ব্যাংকের অর্থ লোপাটের ভয়ঙ্কর চিত্র। কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে ঐ প্রতিবেদনে।

এক বছরের বেশি সময় ধরে ফ্লোরার জালিয়াতির বিষয়গুলো জানাজানি হওয়া সত্ত্বেও লোক দেখানো ছাড়া কার‌্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি অগ্রনী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এ জন্য অগ্রহী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস উল ইসলাম দায়ী বলে ইঙ্গিত করেছেন ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা। অভিযোগ আছে নিয়মিত মাশোয়ারা এবং বিদেশে টাকা পাচারের সুবিধার বিনিময়ে তিনি ফ্লোরা টেলিকমের নানা অনিয়ম ও জালিয়াতির বিষয়ে চুপ থাকছেন। লোক দেখানো ব্যবস্থা গ্রহণের আড়ালে ফ্লোরাকেই চুক্তিতে রাখতে গোপনে ভূমিকা রাখেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস উল ইসলাম। জালিয়াতির কারণে ফ্লোরাকে এজেন্টশিপ থেকে বাদ দিতে চেয়েছে জার্মান কোম্পানি টেমিনস। কিন্তু ফ্লোরা টেলিকম আর অগ্রনী ব্যাংক লিমিটেডের এমডির গোপন আঁতাতের কারণে সেটি পারছে না বলেও অভিযোগ আছে।

হাজার কোটি টাকা লোপাট কিংবা অর্থ পাচারে সহায়তা-বাংলাদেশে ব্যাংক নিজেই যে এমন অপকর্মে জড়িত তার প্রমাণ অনেক। কিন্তু ব্যাংকের দায়িত্বরত শীর্ষ ব্যক্তিদের এমন অপকর্মের বিরুদ্ধে কার‌্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় মূল হোতারা বরাবরই পার পেয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে কেবলই একের পর এক ব্যাংকে ঘটে চলেছে জালিয়াতির নানা ঘটনা। এরই ধারাবিকতায় এবার সামনে এলো অগ্রনী ব্যাংকের অনিয়ম এবং জালিয়াতির ঘটনা। এ ব্যাংক থেকে কত টাকা লোপাট হয়েছে সেই তথ্য এখনো জানার বাকী। তবে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার সফটওয়্যারের গুনগত মান রক্ষা এবং প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ না করলেও কোটি কোটি টাকা রক্ষণাবেক্ষণ কোম্পানিকে দিয়ে যাচ্ছে অগ্রনী ব্যাংক। শুধু যে অর্থের অপচয় হচ্ছে তা নয়, সফটওয়্যারের প্রয়োজনীয় নবায়ন না করার কারণে সরকারী এই ব্যাংকটির সামগ্রিক কার‌্যক্রম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে।
কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে ব্যাংকের নিয়মিত হিসাব ব্যবস্থাপনা ও লেনদেন হয়। এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে ব্যাংকের শাখাগুলো একটি কেন্দ্রীয় সিস্টেমের অধীনে সংযুক্ত থাকে। ফলে রিয়েল টাইমে গ্রাহক যে কোনো শাখা থেকে প্রয়োজনীয় লেনদেন করতে পারেন।

অগ্রহী ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালে লোকান এজেন্ট ফ্লোরা টেলিকম লিমিটেডের মাধ্যমে জার্মান কোম্পানি টেমিনসের সঙ্গে সফটওয়্যার সেবার চুক্তি হয়। ১০ বছর মেয়াদে ১৪ কোটি টাকার বিনিময়ে এ সেবা বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের কথা ফ্লোরার।

প্রয়োজনীয় সেবা না দিয়ে জালিয়াতিপূর্ণ হিসাবের মাধ্যমে ২০১৮ সালে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়ে চুক্তি নবায়ন করে ফ্লোরা। জার্মান কোম্পানি টেমিনসের কাছেও প্রকৃত অর্থের পরিমান গোপন করা হয়। এ জন্য অগ্রনী ব্যাংকের একজন উপ-পরিচালকের সাক্ষরও জাল করে। বিষয়টি ধরা পড়ে যাওয়ার পর ফ্লোরার এজেন্টশিপ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয় টেমিনস। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা পারেনি।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকে সরেজমিন তদন্ত করে কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারের বিভিন্ন দুর্বলতা চিহ্নিত করে। পুরনো সফটওয়্যার ব্যবহারের আড়ালে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টিও স্পষ্ট হয়। আর এতে অগ্রণী ব্যাংকের দায় রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। শুধু মুদ্রা পাচারই নয়, অগ্রণী ব্যাংককে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে রাখার বিষয়টিও তদন্তে স্পষ্ট হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, অগ্রণী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোর ব্যাংকিং সলিউশনের (সিবিএস) ১ হাজার ১৩৭টি কন্ট্রোল পয়েন্টের মাত্র ৫৩৪টি বাস্তবায়ন করেছে। এমনকি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সব শাখায় সিবিএস বাস্তবায়ন করা হয়নি। এ ব্যাপারে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সঠিক তথ্য সরবরাহ করেনি। বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে ব্যাংক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান টেমিনসের স্থানীয় প্রতিনিধি ফ্লোরা টেলিকমের গাফিলতির প্রমাণও পাওয়া গেছে। পারস্পরিক যোগসাজশে ব্যাংক থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় প্রতিনিধি ফ্লোরা টেলিকমকে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে লাইসেন্স ফি বাবদ ৮৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং ২২ মে ২০১৯ তারিখে প্রথম ষান্মাসিকের রক্ষণাবেক্ষণ ফি বাবদ ৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। যেখানে চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে সিবিএস বাস্তবায়ন না হওয়ার দায়ে ব্যাংক কর্তৃক ‘লিকুইটেড ড্যামেজ’ আদায় করার কথা। কিন্তু ফ্লোরা টেলিকম নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সফটওয়্যার বাস্তবায়নে বারবার ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

তদন্তকালে অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সহ শাখা পর্যায়েও অননুমোদিত ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক কানেকশনের ব্যবহার পাওয়া গেছে। যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যাংকের নিজস্ব নীতিকে সমর্থন করে না।
অগ্রনী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম প্রায় ৬ মাস আগে গণমাধ্যমে দাবি করেছিলেন-সফটওয়্যার আটডেট করতে নতুন ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু নানা অজুহাতে এখনও ফ্লোরার সাথেই কাজ করছে অগ্রনী ব্যাংক।

এদিকে সরকারি তিনটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের প্রেক্ষিতে ফ্লোরা টেলিকম লিমিটেডের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্তে নেমেছে। গত বছরের ১৮ নভেম্বর উপপরিচালক ঋত্বিক সাহা স্বাক্ষরিত এক পত্রে দুদকের সিস্টেম এনালিস্ট ও পরিচালককে অভিযোগ অনুসন্ধান করে বিধি মোতাবেক প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য বলা হয়েছে। দুদকের তদন্ত পত্রে বলা হয়েছে, ফ্লোরা টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা রফিকুল ইসলাম ডিউক ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের বিরুদ্ধে দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ, জাল জালিয়াতি, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (ডিইপিপি-৩) এ নকল কম্পিউটার সরবরাহ করে ১৫০ কোটি টাকা লোপাট, অগ্রণী ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকার কাজ নেওয়ার পাঁয়তারাসহ টেলিটকের ৬ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ আনা হয়েছে।