ঢাকার ভয়াবহ অবস্থা: করোনার রোগীরা আক্রান্ত হচ্ছেন ডেঙ্গুতেও!

প্রকাশিত: ৪:৫৬ অপরাহ্ণ, |                          

করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যেই দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। মূলত রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যাপক হারে দেখা দিয়েছে। একই ব্যক্তি একই সঙ্গে কোভিড-১৯ এবং ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। এমন প্রচুর রোগী আসছে চিকিৎসকদের কাছে।

তারা বলছেন, এটা একটা ভয়ঙ্কর বিষয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েও দ্বিধায় চিকিত্সকরা। তারা বলেন, একজন রোগী একই সাথে করোনা ও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। কারণ ডেঙ্গু ও করোনার চিকিৎসা ব্যবস্থায় পার্থক্য রয়েছে। এক্ষেত্রে ভুল চিকিৎসার ঘটনাও ঘটতে পারে। এদিকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্য অধিদফতর ৫টি ডেডিকেটেড হাসপাতাল চালু করছে বলে জানা গেছে।

গত এক দিনে সারাদেশে ১৬ হাজার ২৩০ জন করোনায় শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে শুধু ঢাকা বিভাগেই ৮ হাজার ২৭১ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়েছে যা দিনের মোট আক্রান্তের অর্ধেকের বেশি। আর এই সময়ে যে ২৩৭ জন মারা গেছেন, তাদের ৭০ জনই ছিলেন ঢাকা বিভাগের।

আর এ বছরের সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে চলতি জুলাই মাসে। এখন পর্যন্ত এক হাজার ৭২৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন শুধু জুলাইয়ে। তাদের ৯৯ শতাংশই ঢাকার। আর গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ১৫৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ১৫০ জনই ঢাকার। এটি এ বছরে এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক শনাক্ত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশে অনেকেই ভাবছেন জ্বর মানেই কোভিড-১৯। আর তাই তারা ডেঙ্গু পরীক্ষা না করে বাসায় অপেক্ষা করছেন। কেউ কেউ কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা করালেও ডেঙ্গু পরীক্ষা করাচ্ছেন না। আবার অনেকে কোভিড-১৯ ভেবে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ খাচ্ছেন। এতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। দেরিতে পরীক্ষার ফলে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পরপরই প্লাটিলেটের মাত্রা পাওয়া যাচ্ছে অনেক কম।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু ও করোনা দুটিতেই আক্রান্ত রোগী এখন অনেক পাওয়া যাচ্ছে। জ্বর হলেই প্রথমে করোনা ও পরে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে উদাসিনতা ও ঘামখেয়ালিপনা করলে মৃত্যুর আশংকা রয়েছে। তিনি বলেন, করোনা ও ডেঙ্গু এই দুটির উপসর্গ প্রায় একই, তবে কিছু কিছু পার্থক্য আছে। করোনার উপসর্গ হলো জ্বর, সর্দি, কাশি, গলায় ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, শরীরে ব্যথা ও ঘ্রাণ না পাওয়া। আর ডেঙ্গুর লক্ষণ হলো, ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রি শরীর কাপানো জ্বর, চোখের পাতার পেছনে ব্যথা ও ব্যাপক পেইন এবং গিড়ায় গিড়ায় ব্যথা। শরীরে র্যাশও উঠতে পারে। কোনো কোনো ডেঙ্গু রোগী আক্রান্ত হওয়ার চার দিন পর প্লাটিলেট কমে গিয়ে নাক, দাঁত, পায়খানা ও বমির মাধ্যমে রক্তক্ষরণ হতে পারে। করোনা রোগীদের এন্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন ওষুধ চিকিৎসা সেবায় প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু ডেঙ্গু রোগীর শুধুমাত্র প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেতে হবে, এসপিরিন জাতীয় ওষুধসহ কোনো ধরনের ব্যাথানাশক ওষুধ সেবন করা যাবে না। তবে সেকেন্ডারি ইনফেকশন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এন্টিবায়োটিক খেতে হতে পারে। এছাড়া ডেঙ্গু রোগীর বেশি করে ওরস্যালাইন, ডাব ও অতিরিক্ত পানি খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, এডিস মশার কারণে ডেঙ্গু জ্বর হয়। এডিস মশা দিনে কামড়ায়। শীত না আসা পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকতে পারে। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে। জমে থাকার বৃষ্টির পানিতে এডিস মশার বংশ বিস্তার হয়। ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধ করার জন্য একমাত্র উপায় হচ্ছে এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধ করা। এছাড়া এডিস মশা যাতে না কামড়ায় সেজন্য দিনের বেলায় ফুলহাতা শার্ট পরতে হবে। ঘরের ভিতরে জমাট বাধা পানি পরিস্কার করতে হবে। ঘরে কিংবা তার আশপাশে স্বচ্ছ পানি বেশিদিন রাখা যাবে না।

এদিকে ঢাকা শহরের অনেক বাসিন্দার অভিযোগ হচ্ছে, মশা নিধন করার কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। মশা নিধন করার দায়িত্ব হচ্ছে সিটি করপোরেশনের। কিন্তু এডিস মশা নিধনে তারা সফল নয়। সিটি করপোরেশন শুধু ঢাকঢোল পেটায়, কাজের কাজ কিছুই করে না। বর্তমানে ধানমন্ডি, গ্রিনরোড, হাতিরপুল, মোহাম্মদপুর, গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা, পুরানা ঢাকা, যাত্রাবাড়ি, বাসাবো, তেজগাঁওসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। পুরো রাজধানীতেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু।

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, ডেঙ্গু ও করোনার উপসর্গ প্রায় একই। তবে কিছু পার্থক্য আছে। দুইটার ক্ষেত্রেই জ্বর, গলা ব্যথা, সর্দি, কাশি এবং স্বাদ না থাকা হতে পারে। করোনার ক্ষেত্রে এসব লক্ষণের সাথে নাকে ঘ্রাণ পায় না এবং কারো কারো পাতলা পায়খানা হয়। এছাড়া করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা হতে পারে, যেটি ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে হয় না। ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে চার-পাঁচ দিন পরে শরীরে লাল অ্যালার্জির মতো র?্যাশ হতে পারে। তখন রক্তে প্লাটিলেটের মাত্রা কমে যেতে পারে।

তিনি বলেন, একজন রোগীর ডেঙ্গু ও করোনা এক সঙ্গে হচ্ছে। তাই জ্বর হলেই করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুর পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। নিজের জীবন রক্ষার স্বার্থে দুটি পরীক্ষা করাতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, সারাদেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ৫৬৮ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ৫৫৭ জন, আর বাকি ১১ জন ঢাকার বাইরে আছেন। এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত ২ হাজার ৯৮ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং ছাড়া পেয়েছেন এক হাজার ৫২৬ জন। এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৪ জনের মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনার জন্য রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।