আজ জুমা’তুল বিদা, বিদায় নিচ্ছে মাহে রমজান -মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

প্রকাশিত: ৩:২৭ পূর্বাহ্ণ, |                          

জুমা হলো সপ্তাহের ঈদের দিন; রমজান মাসের একেকটি জুমা অন্যান্য মাসের ৭০টি জুমার সমতুল্য। রমজান মাসের শেষ দশক অত্যন্ত গুরুত্বপৃর্ণ। মাহে রমজানের প্রতিটি দিন তার পূর্বের দিন অপেক্ষা দিগুন ফজিলতপূর্ন। সুতরাং একেকটি জুমা পূর্বের জুমা থেকে বেশি ফজিলত ও বরকত পূর্ণ। আর শেষ জুমা তো রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের পূর্ণতাদানকারী। তাই রমজানের শেষ জুমা “জুমাতুল বিদা” বা বিদায়ী জুমা বলা হয়। রমজানের আগমনে মুমিনের হৃদয়ে যেমন আনন্দের বন্যা বয়ে যায়; তদ্রুপ রমজান বিদায়লগ্নে মুমিনদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে যায়। তাই সবাই বাঁধভাঙা চোখের পানি দিয়ে তাকে বিদায় জানায়। আল বিদা ইয়া মাহে রমজান, ‘আল বিদা’ বিদায় হে মাহে রমজান, বিদায় তোমায়।
দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার বিদায় উপলক্ষে প্রতি বছরই মাহে রমজানুল মোবারকের শেষ শুক্রবার পালন করা হয় জুমাতুল বিদা। যুগ যুগ ধরে এ ঐতিহ্য ইমাম, গাউছ, কুতুব, আলেম-ওলামাগণ উত্তম বলে পালন করে আসছেন। কারণ আল্লাহর পক্ষ থেকে নেয়ামত প্রাপ্তির উপর শোকর করা যেমনি সুন্নত, তেমনিভাবে আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের বিদায়ের উপর আফসোস করাও সুন্নত। একজন আশেকে রাসুল মাহে রমজানুল মোবারকের বিদায়ের উপর আপসোস করে বলেছেন- “আফসোস তো রুখসোদ হুয়া, মাহে মোবারক আল বিদা, রোকে দিল মে ইউ কাঁহা, মাহে মোবারক আল বিদা” সম্পূর্ন কোরআন পাকে ১২টি মাসের মধ্যে কেবল রমজান মাসের নামই জিকির করা হয়েছে, অন্য কোন মাস নয়। যেমন-শাহারু রামাদ্বানাল্লাজী উনজিলা ফি-হিল কোরআন, (সূরা আল বাকারা)। আরবিতে বাকী যে ১১টি মাস রয়েছে তাতে শুধু নির্দিষ্ট তারিখে ইবাদত- বন্দেগী করা হয়। যেমন মহররমের ১০ তারিখে পবিত্র আশুরা, রজব মাসের ২৭ তারিখ পবিত্র মিরাজুন্নবী, শাবান মাসের ১৪ তারিখ শবে বরাত, যিলহ্জ্জা মাসের ৭,৮,৯,১০,১১ ও ১২ তারিখ ইত্যাদি । কিন্তু মাহে রমজানে এধরণের কোন নির্দিষ্ট দিন-রাত বা মুহুর্ত নেই, বরং রমাজানের চাঁদ উদিত হবার সাথে এবং রমজান মাস বিদায় হবার পূর্বক্ষন পর্যন্ত প্রতিটি মুহুর্তেই আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত হয়।
প্রিয় নবী (দ:) রমজান মাসকে ৪ প্রকারে স্মরন করেছেন । যথাঃ ১। শাহ্রি রামাদ্বান, ২। শাহ্রুল মাওয়াচাত, ৩। শাহ্রুচ সবর, ৪। শাহ্রি ওয়াচাতে রিজিক। হযরত ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) তার এহয়াউল উলুম কিতাবে উল্লেখ করেছেন, “আসসাওমু নিসফুস সবর”, অর্থাৎ রোজা হচ্ছে সবরের অর্ধেক । উক্ত কিতাবে তিনি আরো উল্লেখ করেন কেয়ামতের মাঠে মজলুম ব্যক্তি জালেম থেকে সব ইবাদতের বদলা নিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু রোজার ব্যাপারে রাসুল (দ:) বলেছেন, “ফা-ইন্নাহু লা-ইয়াদ্খুলু কেচাচ”, অর্থাৎ জুলুমের মধ্যে রোজার বদলা দেওয়া হবে না। তাই আল্লাহ তায়ালা বলেন, “রোজা আমারই জন্য এবং আমিই এর বদলা দেব”। (হাদিসে কুদসী)। রোজা গোপন ইবাদত। এর বিনিময়ে আল্লাহ পাক রোজাদার বান্দার জন্য এমন প্রতিদান রেখেছেন যে, প্রতিদান দেখলে তাদের অন্তর জুড়িয়ে যাবে। হাশরের ময়দানে যখন আল্লাহর আদালত কায়েম হবে এবং হিসাব নিকাশ চলতে থাকবে তখন রোজাদার বান্দার রোজার বদলা হিসাবে এমন শক্তি অর্জন করবে, যার বদৌলতে তারা উড়াল দিয়ে জান্নাতের বাগানে প্রবেশ করবে। সেখানে কর্তব্যরত ফেরেশতারা তাদেরকে দেখে বিস্মিত হবেন এবং বলবেনঃ তোমরা কি করে এখানে প্রবেশ করলে? তোমরা কি হাশরের ময়দানে যাওনি? তোমাদের কি হিসাব নিকাশ হয়নি? তখন ঐ রোজাদার ব্যক্তিরা বলবেনঃ আবাদানাল লাহা ফিররাহ” আমরা দুনিয়াতে রোজা পালন করেছিলাম, সে রোজার বদলা হিসাবে আল্লাহ আমাদেরকে এমন চড়বিৎ দান করেছেন তাই আমাদেরকে পায়ে হাঁটতে হয়নি। আমরা উড়াল দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করেছি। (আসরারে কওম) এ কারণে মা আয়েশা ছিদ্দিকা (রাঃ) বলেন হে ঈমানদার মুসলমান! তোমরা সে নূরানী জগতে প্রবেশের চেষ্টা কর। মহাকবি ডঃ আল্লামা ইকবাল-উম্মতে মোহাম্মদীকে সে মাকাম অর্জনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন । যেমনঃ দো পাঁ জমি কেলিয়ে না আচমা কেলিয়ে- জাঁহা হ্যায় তেরে লিয়ে দো নেহি যা কেলিয়ে”।
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (দ:) বলেছেন, রমজান মাস যখন শুরু হয় তখন জিব্রাইল (আঃ) এর নেতৃত্বে হাজার হাজার ফেরেশতা পৃথিবীতে তাশরীফ আনে এবং বান্দার অবস্থা অবলোকন করার জন্য বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ফেরেশতারা! তোমরা আমার কাছে আমার বান্দাদের অবস্থা পেশ কর । তখন ফেরেশতারা বলবে, হে আল্লাহ! আমরা দেখেছি তোমার বান্দাদের কেউ রোজা অবস্থায় , কেউ তারাবিহ নামাজে , কেউ ইফতারির মধ্যে, কেউ সেহরীর মধ্যে , কেউ কোরআন তিলাওয়াতে, আবার কেউবা দুনিয়ার স্বাভাবিক জীবন ত্যাগ করে তোমার সন্তুটির জন্য এতেকাফ পালন করছে। ফেরেশতাদের কাছে এ বিবরণ শুনে আল্লাহ তায়ালা গর্ব করে বলবেন, হে ফেরেশতারা! তোমরা তো বলেছিলে, “আল্লাহ”আপনি ইনসান কেন বানাবেন? তারা তো দুনিয়াতে ঝগড়া সৃষ্টি করবে। (সূরা আল বাকারা, আয়াত-৩০)। অথচ তোমরাই এখন স্বাক্ষী দিচ্ছ, আমার বান্দারা আমারই ইবাদতে মশগুল আছে। এখন তোমরাই বলে দাও। আমি আমার ঐ বান্দাদেরকে কি বদলা দেব। ফেরেশতারা তখন লজ্জিত হয়ে বলবে, ‘আপনি তাদেরকে পরিপূর্ণ বদলা দিয়ে দিন’ তখন আল্লাহ ৫টি কসম করে বলবেন, বান্দা’ আমি তোমাদের রোজা গুলির পরিপূর্ণ বদলা দিয়ে দিলাম। যাও! তোমরা ফিরে যাও! আমি তোমাদের কে মাফ করে দিলাম, এমনকি তোমাদের গুনাহসমূহকে নেকীতে পরিপূর্ন করে দিলাম ( মুসলিম ও বায়হাকী শরীফ)।
হযরত জাবির (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে হুজুর (দ:) এরশাদ করেন, যখন মাহে রমজানের বিদায়ের মুহুর্ত হয়, তখন আসমান, জমিন এবং সমস্ত ফেরেশতারা আল্লাহর দরবারে অকাতরে কাঁদতে থাকে। কারণ, রমজান আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ পাক আসমানের দরজা , জান্নাতের দরজা এবং রিজিকের দরজাগুলো খুলে দিয়েছেন। আসমানের ফেরেশতারা এই বলে কাঁদতে থাকে, “আল বিদাউ আল-বিদাউ ইয়া শাহ্রু রামাদ্বান, আল বিদাউ আল বিদাউ ইয়া শাহ্রুল কোরআন”………. । নবী করীম (দ:) আরো ইরশাদ করেন, মাহে রমজান বিদায় হওয়া উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য মুসিবত । সাহাবায়ে কিরামগন জিজ্ঞেস করলেন, ওয়ামাম মুসিবাতি ইয়া রাসুলুল্লাহ (দ:)! রাসুল (দ:) বললেন! বিদাউ ইয়া শাহারু রামাদ্বান…………….।

লেখক:কলামিস্ট ও গবেষক।