দেশে নিখোঁজ নারীদের অধিকাংশই প্রবাসীদের স্ত্রী

প্রকাশিত: ৯:১৪ পূর্বাহ্ণ, |                          

চলতি বছরের ছয় মাসে চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানায় ১৩৯ জন নারী নিখোঁজ হওয়ার তথ্য জানিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও মামলা করেছেন অভিভাবকরা। একই সময় জেলার মতলব উত্তর থানায় ৪৩ নারী ও শিশু নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে জিডি করা হয়েছে। বছরের প্রথম পাঁচ মাসে চাঁদপুর সদর মডেল থানায় ৯৭ জন নারী ও কিশোরী নিখোঁজ থাকার বিষয়ে জিডি হয়েছে। শুধু চাঁদপুরের থানাগুলোতে নয়, দেশের অন্যান্য থানাতেও নারী ও কিশোরী নিখোঁজ হওয়ার জিডি এবং মামলার সংখ্যা উদ্বেগজনক। প্রশ্নœ উঠেছে, এত নারী নিখোঁজের রহস্য কী।

এর কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে নানা চমকপ্রদ তথ্য। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, নিখোঁজ এসব নারীর মধ্যে অধিকাংশই স্কুল-কলেজের ছাত্রী, আর বড় একটি অংশ প্রবাসীর স্ত্রী। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে ছেলেদের প্রতি আসক্ত হয়ে ঘর ছাড়ছেন। আবার ঘর ছেড়ে অনেকেই হচ্ছেন প্রতারিত ও পাচারের শিকার।
১ জুন রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন ভারতের বেঙ্গালুরুতে ৭৭ দিন আটকে রেখে যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার এক তরুণী। ওই মামলার আসামি রিফাতুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় বাবু, মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও আবদুল কাদেরসহ কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তাদের দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, ‘গত আট বছরে এই চক্রটি প্রায় দেড় হাজার নারীকে পাচার করেছে।’ অপরাধ-বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, নিখোঁজ থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে জিডি হওয়া বহু নারী বিদেশে পাচারেরও শিকার হচ্ছেন।

সারা দেশে বছরে কত নারী নিখোঁজ হন এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই পুলিশ সদর দফতরের কাছে। পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, ‘থানাভিত্তিক জিডির তথ্য থাকলেও কেন্দ্রীয়ভাবে সেটি সমন্বয় করা হয় না।’ তাই বছরে দেশ থেকে কত নারী নিখোঁজ হয় এর পরিসংখ্যান জানা যায়নি। কোনো বেসরকারি সংস্থাও নিখোঁজের বিষয়ে তথ্য সংরক্ষণ না করায় এর প্রকৃত হিসাব পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

মাত্র পাঁচ মাসে ৯৭ জন নারী ও কিশোরী নিখোঁজ থাকার তথ্য দিয়ে জিডি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে চাঁদপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুর রশিদ বলেন, ‘আমরা বিষয়গুলো গভীর পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, নিখোঁজ নারীদের বেশির ভাগই প্রবাসীদের স্ত্রী। সাধারণ মানুষের সবার হাতে হাতে এখন স্মার্টফোন। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ভিগো, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ ও টিকটক অ্যাপসসহ বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করেন। এসবের মাধ্যমে ছেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাদের। অনেকে বখাটে যুবকদের পাল্লায় পড়ে ঘর ছাড়ছেন।’ ওসি আরও বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় স্কুল-কলেজে পড়া কিশোরীরা ঘর ছাড়ছে। তারাও স্মার্টফোন ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেলেদের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ করছে এবং আসক্তি ও নানাবিধ প্রলোভনে পড়ে ঘর ছাড়ছে।’ তার মতে, ‘করোনা সংক্রমণজনিত কারণে স্কুলগুলাতে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে। অনেক অভিভাবক ছেলে-মেয়েদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিয়ে মনে করেন, সন্তানরা অনলাইনে ক্লাস করে। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে সেটি হচ্ছে না। প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক ছেলেমেয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে।’

চাঁদপুর পুরান বাজার মহিলা কলেজের ছাত্রী বিউটি (ছদ্মনাম) নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে জিডি করেন তার মামা। মামার কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার ভাগ্নির বয়স ১৭ বছর। এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। ভালো ছাত্রী। কিন্তু হঠাৎ তার আচরণে পরিবর্তন আসে। মে মাসের শেষের দিকে কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে লাপাত্তা হয়ে যায় সে। পরে জানতে পারি হাজীগঞ্জ এলাকার এক ছেলের সঙ্গে কক্সবাজার চলে গেছে। এরপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ওই ছেলে বখাটে এবং টোকাই প্রকৃতির। থানায় জিডি করার পর পুলিশ চেষ্টা করেও ভাগ্নিকে দেড় মাসেও ফেরত আনতে পারেনি।’

সদর মডেল থানায় একই দিন জিডি হয় ২৮ বছর বয়সী এক নারী নিখোঁজ থাকার বিষয়ে, যার স্বামী ছিলেন সৌদি আরব প্রবাসী। পরে ওই নারী ফিরে আসেন। কেন ঘর ছেড়েছেন জানতে চাইলে ওই নারী বলেন, ‘বুঝতে পারিনি। ভুল করে ফেলছিলাম।’ ওই নারীর স্বামীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনিও বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে বলেন, ‘রাগ করে মামার বাড়িতে চলে গিয়েছিল। এখন সব ঠিক হয়ে গেছে।’

গত ছয় মাসে ২৪ জন নারী নিখোঁজের বিষয়ে জিডি হয়েছে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায়। ওসি মশিউর রহমান জানান, জিডির তথ্য অনুযায়ী নিখোঁজ হওয়া ১৬ জন কিশোরী ও সাতজন প্রাপ্তবয়স্কা। একই সময় মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানায় নিখোঁজের অভিযোগ এসেছে ৫২টি, যার মধ্যে ১২টি অভিযোগ পুলিশ রেকর্ড করেছে। থানার ওসি হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, ‘প্রযুক্তির সহজলভ্যের কারণে সহজেই ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে। তারা ভিডিও কলে কথা বলছে। অগোচরে দেখা-সাক্ষাৎ করছে। এর মাধ্যমে অনেকে প্রতারিত হচ্ছে।’ অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখছি, ‘ছেলেরা কৌশলে মেয়েদের অন্তরঙ্গ কোনো ছবি তুলে বা ভিডিও করে তাকে ব্ল্যাকমেল করছে।’ তার মতে, ‘কেউ সহজে পুলিশের কাছে যায় না। সহ্যসীমার বাইরে গেলে তখন পুলিশকে অবহিত করা হয়। তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে যায়। পুলিশ তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়গুলো সমাধানের চেষ্টা করে।’

চাঁদপুর জেলার পুলিশ সুপার মিলন মাহমুদ বলেন, ‘নারী ও কিশোরীদের নিখোঁজের জিডি বা মামলায় অভিযোগের ধরন আলাদা থাকে। কেউ হয়তো প্রেম করে কোনো যুবকের সঙ্গে চলে যায়। তখন অভিভাবকরা অপহরণ মামলা করেন। আবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে এলে ধর্ষণ ও অপহরণের মামলা করেন। কোনটা প্রেম সম্পর্কিত আর কোনটা অপহরণ তার ধরন আলাদা করা হয় না। তবে ধরন যা-ই হোক, ঘটনাগুলো উদ্বেগজনক।’ নারীদের অধিক মাত্রায় নিখোঁজ হওয়ার কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, ‘নারীদের হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া বড় উদ্বেগ ও আতঙ্কের। কিশোরী ও তরুণীরা এখন খেলাধুলা, বান্ধবীদের সঙ্গে মেশার সুযোগ পায় না। তারা ভার্চুয়াল জগতে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। প্রথমে তারা বিনোদনের জন্য ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশ করলেও একসময় অদেখা ছেলের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। ভিডিও কলে কথা বলছে। কিন্তু সে কার সঙ্গে কথা বলছে তার আসলে পরিচিতি জানতে পারছে না। একসময় ওই ছেলের মিষ্টি কথায় ঘর ছেড়ে বিপদে পড়ছে বা প্রতারিত হচ্ছে। এসবের প্রতিকার করতে হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। অভিভাবকদের উচিত কঠোর পর্যবেক্ষণে রাখার পাশাপাশি সন্তানকে গুরুত্ব দেওয়া, তার কথা শোনা, যাতে সে ভুল পথে পা বাড়াতে না পারে।’বিডিপ্রতিদিন।