আবেগের বিবাগী,বাউল আব্দুল হামিদ জালালী- আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্

প্রকাশিত: ৪:০৮ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১০, ২০২৪

আবেগের বিবাগী,বাউল আব্দুল হামিদ জালালী- আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্

 

“ঝাঁকে উড়ে আকাশ জুড়ে
দেখতে কী সুন্দর কবুতর,
দেখতে কী সুন্দর
জালালের জালালি কইতর…”
হযরত শাহজালাল ইয়ামনি রহমাতুল্লাহ আলাইহি কে ভালোবেসে এমন সুন্দর গান ও সুরস্রষ্টার এক কথায় এক নাম-বাউল আব্দুল হামিদ জালালী।যিনি নিজ ঘরানায় অগুনতি গানের স্রষ্টা।অসংখ্য ভক্তের গুরু।দোতরার তারে-তারে কিংবা গানের সুরে-সুরে পাগল করা বাউল শিল্পী।আশায়-আশায় হিসাব কষে,শরীরের সাথে যুদ্ধ করে যার অবস্থান আজ পরপারে।পাঠক চলুন,তাঁর সাথে পরিচয় হোক,একটু থেকে আরেকটু।
বাউল আব্দুল হামিদ জালালী বাউল,মরমী কিংবা জালালী তকমার আগে জন্ম নেন-১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুন।তারপর সিলেটের বুকে আবাসিক সংস্থানের আগে কাগজে-কলমে বগুড়া অঞ্চলের আড়িয়া চক নন্দন সোনাতলা থানা ছিলো তাঁর শৈশব কৈশোর বা যৌবনের অঞ্চল।সেখানেই এক মাথা আকাশ নিয়ে মো.আবু তালেব,
মা-জুবেদা খাতুনের কোলের আলো হয়ে আসেন।
প্রাইমারি ক্লাসের গন্ডি পেরিয়েই ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে ঝুঁকে পড়েন বাউলের গানে গানে।এরপর হাইস্কুল জীবনের সন তারিখ অতিক্রম করে ভর্তি নেন নিজ জেলার নাজনীন আক্তার কলেজে।এবং সেখান থেকে বি.কম.পাস করা মাত্র ইয়াহিয়ার জল্লাদবাহিনী পূর্বপাকিস্তানের কিছু কুলাঙ্গারের মদদে যখন নিরীহ মানুষের চোখের জল গড়াতে থাকে তখনই ডাক আসে লাল সবুজ পতাকার।বজ্রকন্ঠে স্বাধীনতার ডাক দেন,সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি,জাতির জনক,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম”…ব্যস!বি.কম.পড়ুয়া আব্দুল হামিদ হাতের খাতা -কলম ছুঁড়ে ফেলে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে লেফটেন্যান্ট কর্নেল নুরুজ্জামানের অধীনে ৭ নম্বর সেক্টর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন মহান মুক্তিযুদ্ধে।
ছাত্রত্ব থাকাকালীন সময়েই আব্দুল হামিদ আরেকটি কাজ অবশ্য মন মন্দিরে চালান করতে পেরেছিলেন,আর সেটি গান লেখার মনোজ বাসনা।ছোট একখন্ড কাগজ নিয়ে বের হতেন এবং হাঁটতে-হাঁটতে কিংবা বসতে- বসতে বা কথার ফাঁকে-ফাঁকে লিখে ফেলতেন গানের মুখ,অন্তরা,সঞ্চারি,
আভোগের সাথে পুরো একটি গানের লিরিক।সংখ্যায় শত শত জালালী বন্দনা,মুর্শিদি,🤗কাম-দেহ-খেদ,দেশ কিংবা বঙ্গবন্ধুর ওপর পুরো একটি গান লিখে ঘরে ফিরে সুর দিতেন দোতরায়।গীতিকার ও সুরকার আব্দুল হামিদের ওস্তাদ ছিলেন-শাহ্ রমজান আলী।
যুদ্ধ শেষে বাউল আব্দুল হামিদ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন নি বগুড়ায়।১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের দিকে ঢাকার অলি গলি বাউল কে টানে।তিনি ঢাকায় যান।সেখানে যোগদান করেন,বাউল শিল্পীদের একাডেমিতে।এরপর একদিন শাহজালাল ইয়ামনি রহমাতুল্লাহি আলাইহি র দরগা থেকে স্বপ্নযোগে দাওয়াত পান ওরুষে আসার।তিনি আসেন।এবং ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করেন শাহজালাল(রঃ)দরগায় ওরুষের গান।এবং তাঁর গান নিয়েই যুক্ত হয়ে পড়েন তৎকালীন রেডিও বাংলাদেশ সিলেটে।সে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের কথা।এরপর গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী হয়ে রেডিও সিলেটে জমা করেন অসংখ্য গান।এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য গান ছিলো-“দিনের নবী মোস্তাফায়/রাস্তা দিয়া হাইটা যায়/হরিণ একটা বান্ধা ছিলো গাছের ই তলায় গো/গাছের ই তলায়”…
“মায়াবিনী কাল সাপিনী/মায়াবিনী কাল নাগিনী/মায়াবিনী রাক্ষসীনী জগৎ খেয়ে চেয়ে রয়/পুরুষ মরে বে-বিচারে/নারী কিন্তু দোষী নয়…” তাঁর ছেলে ওয়াসিম বলেন-“বাবা রেডিওতে রেকর্ডিং রুমে ঢুকেছিলেন একটি গান রেকর্ডিং করবেন বলে।কিন্তু তাঁর দোতরায় এমন এসক্ ওঠে যে,তিনি আর থামেন নি।একসাথে ১১টি গান রেকর্ড করে তবে তিনি বের হন।এমন ছিলো তাঁর আকাশরাজ্য থেকে পাওয়া প্রতিভা।”
নিজের কিছু অন্যের কাছে ছড়িয়ে দিতে গ্রুপ বন্ধনীতে বিশ্বাসও ছাড়েনি বাউল আব্দুল হামিদকে।বন্ধনে বিশ্বাস করতেন আব্দুল হামিদ তাই ১৯৭৮ কিংবা ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের কোন একদিন গঠন করেন জালালিয়া শিল্পীগোষ্ঠী নামক গানের দল।
কথা হচ্ছে-বগুড়ার মানুষ সিলেটে?কবে?কখন?বা কেনো?এর উত্তর পেতে প্রশ্নকে এগিয়ে দিই তাঁর সহধর্মিনী,সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সংরক্ষিত আসনের সাবেক মহিলা কাউন্সিলর ও পুরাতন স্বনামের ব্যবসায়ি জনাব,শেখ উসমান উল্লাহর কন্যা জাহানারা খানম মিলনের গলায়।তিনি বলতে থাকেন-“তিনি ছিলেন হযরত শাহজালাল ইয়ামানী রাহমাতুল্লাহ আলাইহি র নিদারুন ভক্ত।স্বপ্নযোগে শাহজালাল(রঃ)দরগায় ওরুষের নিমন্ত্রণ পেয়েই বগুড়া জেলার আড়িয়া চক নন্দন সোনাতলা থেকে ছোটে আসেন বি.কম.পাশ করা সুদর্শন বাউল আব্দুল হামিদ।”এসেই জাহানারা খানম মিলনের চোখের সাথে নিজের আরও দুটি চোখ বিদ্ধ করে প্রেমকে প্রশ্রয়ি করে তুলে মিলনের ঐকান্তিক ইচ্ছাকে বাবা উসমানের কাঁধে সওয়ারি করে বিবাহবন্ধনে আবিষ্ট হোন-সে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে।এরপর তো অন্য ইতিহাস। তাঁদের সংসারে যুক্ত হয় তিন ছেলে,আর দুই মেয়ে।বাউলকে আটকানো বাউলের স্বভাব বিরুদ্ধ হলেও আমাদের বাউল আব্দুল হামিদ আটকা পড়েন-প্রেমে, স্নেহে,এবং সাংসারিক কর্তব্যে।ফিরে যাওয়া হয়নি ফেলে আসা সোনাতলায়।হয়ে ওঠেন নতুন ঠিকানা সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত গোয়াইপাড়া এলাকার মল্লিকা ৬৪/১,এর বাসিন্দা।
তাঁর বিখ্যাত অনেক গানের মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখের দাবী রাখে-১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে রচিত জালালি কবুতরের প্রেমে পড়া গান-“ঝাঁকে উড়ে আকাশ জুড়ে/দেখতে কী সুন্দর কবুতর,/দেখতে কী সুন্দর/জালালের জালালি কইতর”…
এছাড়া
“হে জালালি কইতর তুৃমি লইয়া যাও খবর/
সিলেটেতে আছে যেথায়/শাহজালালের ঘর”…
“আমারে লইয়া চল জালাল বাবার বাড়িতে/প্রানবন্ধুর বাড়ি গেলে শাম্তি লাগে দিলেতে”…
“বাগানে ফুল ফুটেছে ঢেউ লেগেছে দরিয়ায় গো/ঢেউ লেগেছে দরিয়ায়/বনে বনে জাগলো পাখি/গান ধরেছে পাপিয়ায়”…
” তুমি ভুলে গিয়েছো আমিও ভুলে গিয়েছি/কেউ কারো রাখি না খবর ও বন্ধুরে/তোমার লাগি কাঁদে আমার কান্দে আমার অন্তর”…
“ও মন চিন্তা করো রে/ও মন ভাবনা করো রে/একদিন তোর বিয়ার সাজন সাজাইবে রে”…
কি যেন কী হইলো গো আমার/ভালোবেসে তারে/বুকে আমার চিতার আগুন/আগুন জ্বলছে ধীরে ধীরে “…
” ভালোবাসা শুধু রূপের নেশা/জগতে নাই যার তুলনা/যে যাহারে ভালোবাসে বন্ধু/সে তাহারে ভুলে না”…
এ রকম অনেক গানের সুরস্রষ্টা বাউল আব্দুল হামিদ জালালীর গানের কথা বলতে গিয়ে তাঁর পরিবারের সাথে গলা মিলিয়ে সহধর্মিনী মিলন বলেন-“তাঁর রচিত ও লিপিবদ্ধ প্রায় ৮ টি ডায়রি বাউলের কাছে সংরক্ষিত ছিলো, তিনি যেখানেই প্রোগ্রামে যেতেন এই ৮টি ডায়রি তাঁর সাথে থাকতো।এমন কী চার-চার বার লন্ডন এবং ইন্ডিয়াসহ বহু দেশ ভ্রমনকালীন এ ডায়রিগুলো তাঁর সাথে ছিলো।এ সময় অনেক ভক্ত ও শিষ্যের মাধ্যমে ডায়রি ও গানের অসংখ্য পাতা বেহাত হয়ে যায়।তারমধ্যে যে গানগুলো আমাদের সংরক্ষণে আছে,আগামীতে এগুলো বই আকারে প্রকাশের ইচ্ছা রাখি”।
বিগত ২৪ ডিসেম্বর ২০২২ খ্রিস্টাব্দ ৯ পৌষ ১৪২৯ বঙ্গাব্দ শনিবার,মোলাইম একটা শীতের রাত কে নিয়ে ৯ টায় বাউল আব্দুল হামিদ জালালীর খবর নিতে গিয়ে শরীরের বেহাল অবস্থা প্রত্যক্ষ করে বড় ব্যতীত হয়েছিলাম।সে ই ছোট্টকালে দেখা স্টেইজে বা বাড়ির পাশে কালা শাহ (রঃ)র মাজারে সাদা শাল কিংবা গামছা ও কফি কালারের পুঁতির মালা গলায় জড়িয়ে পানে লাল ঠোঁটে বাবড়ি দোলানো চুলের সেই আব্দুল হামিদ কে আর চেনা যাচ্ছিলো না।রুগ্ন,কংকালসার এমন শিল্পীকে দেখবো ভাবতে পারি নি।তবুও অগুনতি ভক্ত হৃদয়ের মানুষটির ক্ষীণ অবস্থাকে পুঁজি করে হলেও তাঁর নিজ কর্মগুনের স্বাক্ষী ছেলে-
মো.ওয়াসিম,মো.মোক্তাদির,মেয়ে-সুবর্ণা হামিদ ও সাবিনা আক্তার,তাকিয়া খান কিংবা ঘনিষ্ঠজনদের জবানিতে বাউল হামিদ কে পাঠকের সামনে তুলে ধরার প্রচেষ্টা নিলাম।জীবিতের মূল্যায়নে বড়ো কাঙাল লোকটি ২০০৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে বার বার অসুস্থ ছিলেন।তাঁর ওপর চার-চার বার স্ট্রোক করে বড়ো বেমানানভাবে ধরাশায়ী।খুব সখ করে তাঁকে আমাদের পাশে বসিয়ে পরিবারের জবানবন্দি ও প্রমানীয় নানান কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি ছাড়া তাঁর কাছ থেকে শুধুমাত্র চোখের পলক,ঠোঁটের হালকা কাঁপুনি,
ডানহাতের নড়চড় ও কান কে খোলা রেখে কথা বের করে আনা কঠিন ছিলো।তবে অনেকটা অচেতন থাকলেও প্রত্যক্ষ করেছি- কেউ যদি তাঁর কানে তাঁর গানের সুর শুনায় তবে বাউল আব্দুল হামিদ জালালী ডান হাতটি চেয়ারের হাতলে দোলান।কেউ যদি আহলাদিও সুরে কিছু বলে-তবে করমর্দনের জন্য হাত তোলার চেষ্টা করেন।এ থেকে আমরা অনুমান করতে পেরেছিলাম;বাউল রা মানুষ।সজাগ মানুষ।মানবিক মানুষ।প্রাণের মানুষ।ভালোবাসার মানুষ।আর এসব প্রত্যক্ষ করেই লেখাটি তৈরি করে রেখেছিলাম।এবং পরিবার সূত্রে অজানা থেকে জেনেছিলাম বাউল আব্দুল হামিদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।সোনাতলার যুদ্ধদিনের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে চেতনবেলায় বড়ো আফসোস ছিলো তাঁর অন্তত মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।আর স্বীকৃতির দাবি নিয়ে এ ঘাট ঐ ঘাট দৌঁড়ে বড়ো ক্লান্ত পথিক হয়ে জীবিতকালীণ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির আশাকে পাঁজরদোলা করে গত ১৯ এপ্রিল ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের বুধবার রাতে দিকে শরীরকে নিয়ে আরও বড়ো বেকায়দায় উপস্থিত হন।তখন পরিবার তাঁকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেন।সেখানে জরুরি ভিত্তিতে আই.সি.ইউ.র প্রয়োজন হলে ১০ সীটের আই.সি.ইউ.বাউলকে বিছানা দেয়নি। পেরেছিলো-সিলেট শহরস্থিত বেসরকারি মেডিকেল- রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।আর সেখানেই বুধবারের রাত্রিকে শুধুমাত্র অতিক্রম করে আবেগের বিবাগী বাউল আব্দুল হামিদ জালালী পরেরদিন ২০ এপ্রিল ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ বৃহষ্পতিবারের নতুন সূর্যকে বরণ করে ভর দুপুরের দিকে ৭৩ বছর ১০ মাস ৫ দিনের মাথায় আই.সি.ইউ.র শ্বাসনালীতে তাঁর নিজের শ্বাসকে বিদায় দিয়ে চিরতরে চলে যান না ফেরার দেশে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।