দায়িত্বশীল মিডিয়ার ভূমিকা

প্রকাশিত: ১২:২৪ পূর্বাহ্ণ, |                          

“মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান”

বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রকাঠামোর নাম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো। এমনকী, যে রাষ্ট্রে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের চর্চা করা হয় সেখানেও বাহ্যত গণতন্ত্রের খোলস বজায় রাখা হয়। আর গণতন্ত্রের অন্যতম মেরুদন্ড হলো একটি স্বাধীন, পেশাদার ও দায়িত্বশীল গণমাধ্যম। মিডিয়াকে ফোর্থ এস্টেট এবং জনমতের প্রভাবক হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়া হয়। মিডিয়ার মুখ্য দায়িত্ব হলো জনগণকে অবহিত করা, দেশে চলমান নানা কর্মকান্ডের গঠনমূলক সমালোচনা করা এবং ইতিবাচক বিতর্ককে উদ্দীপ্ত করা।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, গণমাধ্যম বা মিডিয়ার একটি সংজ্ঞা ও অবকাঠামো সর্বাগ্রে নির্ধারণ করা উচিত। পাশাপাশি, মিডিয়া কীভাবে রিপোর্ট করে সেই বিষয়েও দায়বদ্ধ হওয়া উচিত এবং সংবাদপত্রের বিশ্লেষণ এবং মতামতগুলোকে প্রচারিত ও প্রকাশিত তথ্য থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা করা উচিত।
বর্তমান সময়কে বলা হয় সিটিজেন জার্নালিজমের সময়। ইতিমধ্যেই, নানাক্ষেত্রে বিশেষ করে ইস্যু তৈরিতে এমনকী নীতি নির্ধারকদের সিদ্ধান্ত বদলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা স্পষ্ট হয়েছে। মানুষ তার দিনের একটি বড়ো অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য দেয়া বা নেয়ার ক্ষেত্রেই ব্যয় করছে। তবে, একইসাথে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নানা দুর্বলতাও দৃশ্যমান হয়েছে। এ বাস্তবতায়, স্বাধীনতা ও সংযমের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তির ‘আত্ম-নিয়ন্ত্রণের’ ভূমিকা ও গুরুত্ব অনেক বেশি অনুভূত হয়েছে।
বিশ্বাসযোগ্য হতে হলে যেকোনো দায়িত্বশীল গণমাধ্যমকে অবশ্যই সত্যনিষ্ঠ হতে হবে। এর জন্য গণমাধ্যম কর্মীদেরকে যে কোনো তথ্য ও ঘটনার অভ্যন্তরে যেতে হবে। ঘটনার বিভিন্ন দিক প্রকাশ্যে নিয়ে আসার জন্য অনেক লোকের সাথে কথা বলতে হবে এবং যেকোনো তথ্য ও সত্যকে বস্তুনিষ্ঠভাবে যাচাই বাছাই করতে হবে। মিথ্যা, ভন্ডামি ও দুর্নীতির মূলোৎপাটন এবং উন্মোচন করতে দ্বিধাবোধ করার কোনো সুযোগ গণমাধ্যমের নেই, তবে তা করার আগে এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হলে গণমাধ্যমকে জনপ্রিয় হওয়ার খায়েশে, ভাইরাল হওয়ার অভিসন্ধি নিয়ে কিংবা সংবাদপত্রের কাটতি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যে কোনো তথ্য অতিরঞ্জন করা এবং ভয়ভীতি ছড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, দায়িত্বশীল হওয়া মানে কেবলই সত্য বলা নয়। বরং দায়িত্বশীল হওয়ার জন্য আইন মেনে চলতে হবে এবং এক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহ করার প্রক্রিয়াতেও সততা অবলম্বন করা অপরিহার্য। সংবাদপত্র বা সংবাদপত্রের কর্মীরাই যদি আইন ভঙ্গের দিকে ঝুঁকে পড়েন তাহলে এর পরিণতিতে সংবাদপত্র পাঠক ও জনগণের কাছে তার সম্মান, মর্যাদা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। এক্ষেত্রে ২০১১ সালের একটি ঘটনা আমাদের স্মরণ করা উচিত যা ঘটেছিল যুক্তরাজ্যে। সেই সময়ের যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বেশি সার্কুলেটেড ট্যাবলয়েড পত্রিকা ছিল নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড। এই ট্যাবলয়েডটি ১৮৪৩ সাল থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। এই ট্যাবলয়েডের একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে বৃটেনের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ থেকে সাধারণ অনেক নাগরিকের ফোনে আড়িপাতার অভিযোগ ওঠে। তথ্য মিলে যে, ঐ সাংবাদিকটি বৃটিশ রাজপরিবারের সদস্য, সুপরিচিত রাজনীতিবিদ, অভিনেতা এবং ক্রীড়াবিদদের পাশাপাশি নিহত একটি স্কুলছাত্রীর পরিবার এবং আফগানিস্তান যুদ্ধে নিহত এক বৃটিশ সেনার পরিবারের সদস্যসহ অনেকের মোবাইল ফোন ও ভয়েস মেইলে অবৈধপন্থায় একসেস নিয়েছিলেন। এ ঘটনার জেরে প্রকাশনার ১৬৮ বছর পর নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড ট্যাবলয়েডের প্রকাশ বন্ধ করে দেয়া হয়।
গণমাধ্যমের জন্য বড়ো চ্যালেঞ্জ হলো রাজনীতিবীদদের বিরাগভাজন না হওয়া। তবে, বাস্তবতা হলো, যারা তৃণমূল থেকে উঠে এসে রাজনীতি করেন এবং জনকল্যাণমূলক রাজনীতির সাথে যারা সম্পৃক্ত, তাদের সাথে ঐতিহাসিকভাবেই গণমাধ্যমকর্মীদের সুসম্পর্ক রয়েছে। এমনকী, গণমাধ্যমে কাজ করেও অনেকে রাজনীতিবিদ হয়েছেন আবার এমনও বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে যেখানে রাজনীতিবীদ বা তার পরিবার থেকে গণমাধ্যমও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু রাজনীতিতে যখন থেকে ভুঁইফোঁড় ব্যক্তিত্বের সংখ্যা বেড়েছে, কিংবা রাজনীতে যখন ব্যবসায়ীসহ আর্থিক মুনাফা অর্জনের অভিপ্রায়সম্পন্ন ব্যক্তির প্রবেশ ঘটেছে তখন থেকেই গণমাধ্যমের বিষয়ে স্পর্শকাতরতা যেন অনেকটাই বেড়ে গেছে। এমনটা হওয়া প্রত্যাশিত নয়। যদি একজন রাজনীতিবিদ সংবাদপত্রের সমালোচনা গ্রহণ করতে না পারেন তাহলে বুঝে নিতে হবে তার পরিপক্কতায় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কেননা, বলা হয়ে থাকে, ‘একজন রাজনীতিবিদের জন্য প্রেস সম্পর্কে অভিযোগ করা আর সাগর সম্পর্কে জাহাজের ক্যাপ্টেনের অভিযোগ করা একই কথা।’
দায়িত্বশীল মিডিয়া কীভাবে বিকশিত হতে পারে?
যে কোনো প্রকল্প বা উদ্যোগ সফল হওয়ার জন্য একটি পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত রোডম্যাপ থাকা দরকার। এই রোডম্যাপটি এমনভাবে তৈরি করা উচিত যাতে উদ্যোগ বাস্তবায়নের পথে আগত যে কোনো চ্যালেঞ্জ বা অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া যায়। সংবাদপত্রও এই মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে নয়। তবে, এতটা পরিশীলিত পন্থায় যদি গণমাধ্যম কাজ করতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই মানসম্পন্ন সাংবাদিক তৈরি করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট টিমের সদস্যদের মাঝে স্থায়িত্ব বা টেকসই মানসিকতা, বৈচিত্র, সমতা, ভারসাম্য এবং সকলের অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
সংবাদপত্রের মালিক ও বিজ্ঞাপনদাতা- উভয়কেই আর্থিক খাতে কিছুটা ছাড় দেয়ার মানসিকতা রাখতে হবে যাতে সংবাদপত্রের অভ্যন্তরে উপরোক্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত করা যায়। কোন ধরনের খবর বা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় এবং সংবাদকর্মীদের কাজের ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করা যায় তাও বিবেচনায় রাখতে হবে। গড়পড়তায় একটি অভ্যাস আমাদের অনেকেরই আছে আর তাহলো, আমরা পাঠকের রুচি ও চাহিদার আলোকে কনটেন্ট তৈরি করি। কিন্তু দায়িত্বশীল গণমাধ্যমকে অবশ্যই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসালে চলবে না। বরং জনমত ও জনগণের রুচি তৈরিতেও তাদের ভূমিকা রাখতে হবে।
অত্যন্ত মর্মান্তিক বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশে সেক্যুলার ও বাম ঘরানার গণমাধ্যমগুলো জনমত ও পাবলিক পারসেপশন তৈরিতে অনেক বেশি এগিয়ে আছে। তারা জনগণের পছন্দ নির্ধারণ করছে। রাজনীতির গতিপথ নির্ধারনে ভূমিকা রাখছে। কূটনৈতিক দূতিয়ালিতে প্রভাব বিস্তার করছে। পছন্দসই ব্যক্তিকে হিরো বানাচ্ছে। আর অপছন্দের ব্যক্তি তিনি যদি সৎ ও দেশপ্রেমিকও হন, তারপরও তাকে ভিলেন বানিয়ে দেয়া হচ্ছে। গণমাধ্যমগুলো অনেকক্ষেত্রেই পাবলিক ট্রায়ালের ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হয়েছে। তারা সমাজে পশ্চিমা সভ্যতা ও শিক্ষা থেকে উৎপাদিত সব উচ্ছিষ্ট আইটেমগুলোকে আমাদের দেশে আমদানি করছে। এগুলো নিয়ে লেখালেখি, আলোচনা ও সেমিনার করার মাধ্যমে সামাজিক ট্রেন্ড হিসেবে এ অনাচারগুলো প্রতিষ্ঠা করছে। একথা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায় যে, বাংলাদেশের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম একটি দেশে বিকৃত যৌনাচারসহ নানা ধরনের অপসংস্কৃতির প্রচলনের পেছনে বিশেষ কিছু গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দায়িত্বশীল মিডিয়া এমনটা করতে পারে না। শুধু তাই নয়, সংবাদপত্রের সিন্ডিকেট সিস্টেম এবং সহকর্মীদের প্রতি পেশাগত টান ও দায়বদ্ধতার বেড়াজাল ছিন্ন করে হলেও এসব অপপ্রয়াস সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা এবং এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া সত্যিকারের দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের অপরিহার্য দায়িত্ব।
দায়িত্বশীল গণমাধ্যম ন্যায়, সততা, চিরায়ত ঐতিহ্য, দেশপ্রেম এবং ধর্মীয় স্পর্শকাতরতা সমুন্নত রেখে সক্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে মানুষকে সক্ষম করে। আর তা করতে হলে, প্রকাশক, এজেন্সি, প্রযুক্তি এবং সংবাদকর্মীদের দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করে সময়ের চাহিদা পূরণে সচেষ্ট হতে হবে। আজকের সময়ের সম্ভাবনাময় ও প্রতিভাবানদের যেমন কদর করতে হবে এবং পরবর্তী প্রজন্মের ওপর কোন কাজের প্রভাব কেমন পরিলক্ষিত হবে তা বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। দায়িত্বশীল মিডিয়াগুলোকে অবশ্যই তারুণ্যের কন্ঠ শুনতে হবে। এমন একটি কাঠামো ও সুযোগ এ হাউজগুলোতে থাকতে হবে যেখানে তরুণ প্রজন্ম জড়িত হতে, কথা বলতে এবং নিজেদের মতামত শেয়ার করার সুযোগ পায়। এ সুযোগ যত বেশি তৈরি করা যাবে, তত দ্রুত বাস্তব পরিবর্তন দেখা যাবে আবার সময়ের চাহিদাগুলোকে ধারণ করে পরবর্তী কৌশল অবলম্বন করাও সহজ হয়ে যাবে।
গণতান্ত্রিক কাঠামোতে গণমাধ্যমের করণীয়:
সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থানের সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম একটি ভিন্ন কাঠামো লাভ করেছে। প্রথাগত কাগুজে পত্রিকার পাশাপাশি অনলাইনে সক্রিয়তা বৃদ্ধি করেছে প্রতিটি গণমাধ্যম। এক্ষেত্রে সক্রিয়তা, বৈচিত্র্যতা এবং নিরবচ্ছিন্ন তৎপরতা বৃদ্ধির আরো সুযোগ আছে। যেহেতু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য ভেরিফাই করার সুযোগ বা প্রবণতা কম। তাই অনলাইন জগতে দায়িত্বশীল গণমাধ্যমগুলোর দায়িত্ব পালনের দায় অনেকটাই বেশি। দুর্ভাগ্যবশত, এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকাগুলো অনেকক্ষেত্রেই পাঠকের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। গণমাধ্যম আর আর্থিক অসঙ্গতি- এ দুটো শব্দ যেন একইসাথে গাঁথা। তারপরও অর্থের সঙ্গতি না হলে তো এই প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকতেও পারতো না। অর্থ কিছুটা ব্যয় করছে বলেই পত্রিকাগুলো এখনো প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু সীমিত এই অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোন খাতটিকে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে- এ নিয়ে গণমাধ্যমের নীতি নির্ধারকদের মুল্যায়নের ঘাটতি রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়তা বৃদ্ধিকে অর্থ ব্যায়ের অন্যতম মুখ্য খাত হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মিডিয়ার বড় ভূমিকা রয়েছে। একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য, সরকার এবং জনগণের মাঝে একটি সংযোগ সেতু গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক আর গণমাধ্যম ঠিক এ ভূমিকাটিই পালন করে থাকে। যদিও নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রকৃত অস্তিত্ব নিয়ে নানা দেশে নানা বিতর্ক চলমান। তারপরও প্রশাসনের সাথে সমন্বয় না করে গণমাধ্যমের কাজ করার সুযোগ নেই।
সরকার বা জনপ্রতিনিধিরাই দেশের যেকোনো খাতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রাখেন। আর এ সিদ্ধান্তগুলো সঠিক বা ভুল- হতেই পারে। তাই গণমাধ্যমের এ সব বিষয়ে সরব হওয়া চাই। সরকারি পদ গ্রহণ করে এবং ক্ষমতার উত্তরাধিকারী হয়ে যদি কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং নিজের সুবিধা হাসিল করে তাহলে তার বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করার দায়িত্ব গণমাধ্যমের। এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল মিডিয়ার যে কাজগুলো করা উচিত, তা হতে পারে:
প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিরুপণ করা: জনগণের জীবনযাপন, চিন্তাধারার সাথে সরকারের বা প্রশাসনের কাজের ধরনে অনেকটাই পার্থক্য আছে। অধিকাংশ জনগণ প্রশাসনের কার্যক্রম কৌশল সম্বন্ধে অবগত নয়। ফলে তারা এক ধরনের কল্পনার মধ্যে থাকে। আর অসৎ রাজনীতিবিদেরা এ কারণেই জনগণকে বোকা বানানোর সুযোগ পায়।
তাই প্রশাসনের কাছে জনগণ যাতে পৌঁছাতে পারে এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ে তারা যেন স্বচ্ছ ধারণা পায় তা নিশ্চিত করার জন্য দায়িত্বশীল গণমাধ্যমকে কাজ করে যেতে হবে।
সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পন্থায় সত্য প্রকাশ করা: সত্য প্রকাশ করা যায় যে কোনোভাবেই। তবে, যদি প্রকাশ ভঙ্গিমা ভালো না হয় এবং জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না পায় তাহলে প্রকাশিত সত্য জনগণ বুঝতে ও ধারণ করতে পারে না। অসৎ গণমাধ্যম ভালো কোনো ব্যক্তি বা ঘটনাকে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করলেও সাময়িকভাবে মানুষ সেই প্রচারণার ফাঁদে পড়ে যায় কারণ তাদের উপস্থাপন পদ্ধতি বিশ^াসযোগ্য। এ পদ্ধতি ও কৌশলগুলো দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের কর্মীদেরও আয়ত্ত করতে হবে।
জনগণকে তার অধিকার আদায়ে সহায়তা করা: গণমাধ্যমের কর্তব্য নাগরিকদের তাদের অধিকার লালন করতে সহায়তা করা। একই সাথে, নাগরিকরা তাদের অধিকার সঠিকভাবে আদায় করতে পারছে কিনা তাও নিয়মিতভাবে গণমাধ্যমগুলোর যাচাই করা প্রয়োজন।
প্রশাসন ও জনগণ- উভয়ের আস্থা অর্জন করা: সরকার ও জনগণের অবস্থান অনেকক্ষেত্রেই একদম বিপরীতমুখী হয়। তাই এক্ষেত্রে উভয়পক্ষের অবস্থান অনুধাবন করা এবং সেই আলোকে কৌশল প্রয়োগ করা গণমাধ্যমের জন্য সত্যিই চ্যালেঞ্জিং। দায়িত্বশীল গণমাধ্যমকে এক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে দু-ধারী তরবারির ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিতর্ক, সমালোচনার মাধ্যমে দুর্বলতা শনাক্ত করা: একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো তখনই তার সেরা পারদর্শিতা দেখাতে পারে, যখন নীতি নির্ধারকেরা তাদের শক্তিশালী ও দুর্বল দিকগুলো শনাক্ত করতে পারেন। এক্ষেত্রে, দায়িত্বশীল গণমাধ্যম পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে নানা ধরনের প্রাসঙ্গিক বিতর্ক বা আলোচনাকে প্রণোদনা দিতে পারে, প্রশাসনের প্রশংসা ও সমালোচনার দুয়ার খোলা রাখতে পারে এবং সরকারের সামনে তাদের ত্রুটিগুলো নিয়মতান্ত্রিক ও ইতিবাচক পন্থায় ফুটিয়ে তুলতে পারে।
দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি করা: দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের দায়িত্ব হলো নাগরিকদের মধ্যে দেশপ্রেমের বোধ তৈরি করা যাতে তারা যারা কোনো ধরনের ভয়-ভীতি ছাড়াই জাতির উন্নতির জন্য কাজ করতে পারে। দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের কার্যক্রমে অবশ্যই একটি ইতিবাচক দীপ্তি থাকতে হবে যা জনগণের মাঝেও একটি সৃজনশীল আভা ছড়িয়ে দিতে পারে। যেমন: সামাজিক নানা সংকট নিরসনে, এলাকার রাস্তাঘাট ও নর্দমা পরিষ্কার করা, বিপন্ন মানুষকে সহায়তা করা, শীতার্ত মানুষকে কম্বল বিতরণ করা, নির্যাতিত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য দায়িত্বশীল গণমাধ্যম নাগরিকদের উৎসাহিত করতে পারে।
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করা: পাঠকের একটি অভিযোগ হলো, গণমাধ্যমগুলোর খবর অনেকটা একই ধাঁচের। এরকম অভিযোগ সবক্ষেত্রে সত্য না হলেও এর কিছু বাস্তবতাও আছে। লোকবলের সংকট, যোগ্য সংবাদকর্মী ও ভালো সোর্স না পাওয়ায় এবং সর্বোপরি সাহসী সাংবাদিকতা করার আগ্রহ হ্রাস পাওয়ায় অনেকক্ষেত্রেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অনুশীলন আর সেভাবে করা হয় না। দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। পাশাপাশি, জরুরি কোনো বিষয় যেন লোকচক্ষুর আড়ালে চলে না যায়, সে জন্য দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের ফলোআপ নিউজ বেশি করা উচিত।
মত প্রকাশে স্বাধীন হওয়া: দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের উচিত নিজেদের আয় বৃদ্ধি এবং অন্তত সংবাদকর্মীদের সম্মানি দেয়ার মতো আয়ের সংস্থানের উদ্যোগ নেয়া। বিশ^জুড়ে এটি পরীক্ষিত বাস্তবতা হলো, মালিকের অধীনে আঁটকা থাকা অবস্থায় গণমাধ্যমের পক্ষে দায়িত্বশীল, সময়োপোযোগী এবং জনগনের প্রত্যাশার আলোকে ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয় না।
দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের যেমন কিছু করণীয় আছে, তেমনি আবার কিছু বিষয় আছে যা দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের জন্য কখনোই কাম্য নয়। যেমন:
তথ্য বিকৃত না করা: নিউজ বা তথ্য যেভাবে আসে সেভাবেই উপস্থাপন করা উচিত। ঘটনাগুলোকে কোনো অজুহাতেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে টুইস্ট করা বা বিকৃত করা উচিত নয়। এতে করে, নৈতিকতার মান বজায় রাখা সম্ভব হয় না। এতে করে, পাঠক পরিমন্ডলেও সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পায়।
পেইড নিউজ না করা: দায়িত্বশীল মিডিয়ার জন্য পেইড নিউজ করা শোভনীয় নয়। সাম্প্রতিক সময়ে, এই ধরনের নিউজ ও সিন্ডিকেটেড নিউজ করার প্রবণতা বেড়েছে। আর আর্থিক সঙ্গতি থাকার কারণেও গণমাধ্যম এদিকে ঝুঁকছে। দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের উচিত সচেতনভাবেই এ ধরনের কৌশল থেকে দূরে থাকা। যদি কোনো সংবাদকর্মীর বিরুদ্ধে পেইড নিউজ করার অভিযোগ আসে তাহলে গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত যাতে অন্যান্য সংবাদকর্মীও এ ধরনের অন্যায্য কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার বার্তা পায়।
জীবনঘনিষ্ঠ বিষয় এড়িয়ে যাওয়া: সাম্প্রতিক সময়ে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মূল ধারার গণমাধ্যম উভয়ের ক্ষেত্রেই ট্রেন্ড ফলো করার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পাশাপাশি, অতি রাজনীতি ও গতানুগতিক বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকার প্রবণতাও বেশি দেখা যায়। কিন্তু এর বাইরেও বহু সমস্যা আছে। নাগরিক জীবনে বহু সংকটই আছে, যেগুলো বছরের পর বছর একইভাবে মানুষ সহ্য করে যাচ্ছে। এগুলো নিয়ে দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের সরব হওয়া উচিত।
দায়িত্বজ্ঞানহীন সংবাদ প্রচার না করা: গণমাধ্যমগুলো রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত হওয়ায় জাতি হিসেবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বিশেষ করে, রাজনৈতিক নিউজ করার ক্ষেত্রে আমাদের এখানে যে পক্ষপাতদুষ্টু আচরণ করা হয় তা সত্যিই বেদনাদায়ক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইসলামপন্থী মানুষগুলো অনেকক্ষেত্রেই জুলুমের শিকার হয়। দেখা যায়, কোনো একটা নেতিবাচক ঘটনা ঘটামাত্রই কিছু মিডিয়া কোনো ধরনের তদন্ত হওয়ার আগেই ইসলামপন্থীদের দায়ী করে সংবাদ পরিবেশন করে। পরবর্তীতে তদন্তে হয়তো ভিন্ন কিছু বেরিয়ে আসে। কিন্তু আগেভাগেই কাউকে দোষী বানিয়ে দেয়ায় একদিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যেমন সামাজিকভাবে হেয় হন তেমনি তদন্ত কার্যক্রমও ব্যাহত হয়। আর এতে করে সার্বিকভাবে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যায়।
দেশের উন্নয়ন ও জনগণের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য স্বাধীন গণমাধ্যমের কোনো বিকল্প নেই। তবে সেই স্বাধীনতা যেন আমাদের দায়িত্বশীলতাকে ক্ষুণ্ন না করে। মনে রাখতে হবে, এ সময়টি প্রযুক্তি ও অবাধ তথ্য প্রবাহের। তাই জনগণকে বোকা বানিয়ে রাখার কোনো সুযোগ নেই। তেমনি প্রশাসনের সাথে অযাচিত দূরত্ব তৈরি করার কিংবা বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করারও কোনো প্রয়োজন নেই। দায়িত্বশীল গণমাধ্যমকে টিকে থাকতে হবে একটি সম্ভাবনাময় আগামী তৈরির জন্য। আর তা করতে হলে পাঠক মহলের যেমন সচেতন হওয়া জরুরি ঠিক তেমনি গণমাধ্যমের সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদেরও অনেক বেশি দায়িত্বশীল আচরণ করা অপরিহার্য।

লেখক:কলামিস্ট ও গবেষক।