আতিয়া মহলে হামলার চার বছর

প্রকাশিত: ৩:০৯ অপরাহ্ণ, |                          

২০১৭ সালের ২৪ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৪ মার্চ সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি পাঠানপাড়াস্থ আতিয়া মহলে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’র চার বছর পূর্ণ হয়েছে আজ। সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো দলের একটানা ১১১ঘণ্টা অভিযানে মুক্তি পেয়েছিলো সিলেট। জঙ্গিদের সবরকম প্রতিরোধ পরাস্ত করে আতিয়া মহলসহ আশপাশ ভবন থেকে ২০১৭ সালের ২৫ মার্চ ৭৮জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে নিয়ে আসেন সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো দলের সদস্যরা। সেই অভিযানে গুলি-বোমার শব্দে কেঁপে উঠেছিল সিলেট। সেনা কমান্ডোদের অভিযানে নিহত হয়েছিল চার জঙ্গি।

সেনাবাহিনীর অভিযান চলাকালে আতিয়া মহলের অদূরে পাঠানপাড়া দাখিল মাদ্রাসার কাছে পরপর দু’দফা আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল কালাম আজাদ, দুই পুলিশ ইন্সপেক্টরসহ সাতজন মারা যান। আহত হন অর্ধশত সাধারণ মানুষ। অভিযান চলাকালে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা পরিস্থিতিকে করে তোলে আতঙ্কময়, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার। ২০১৭ সালের শুরুর দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে দুই জঙ্গিকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের কাছ থেকেই সিলেটে জঙ্গি আস্তানা থাকার বিষয়টি জানতে পারে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটিটিসি)। সে সূত্র ধরেই সিলেটে কাজ শুরু করেন গোয়েন্দারা। পরে দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি পাঠানপাড়াস্থ পাঁচ তলা আতিয়া মহলে জঙ্গিদের আস্তানা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হন গোয়েন্দারা। জঙ্গি আস্তানা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই ২০১৭ সালে ২৪ মার্চ (২৩ মার্চ দিবাগত রাত ৩টার দিকে) আতিয়া মহল ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জঙ্গিদের ফ্ল্যাটের ফটকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তালা। শুরু হয় বাংলাদেশে এ যাবৎকালে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা শ্বাসরুদ্ধকর জঙ্গিবিরোধী অভিযান।

জানা যায়, সিলেটের আতিয়া মহলের অদূরে পাঠানপাড়া দাখিল মাদ্রাসার কাছে পরপর দু’দফা আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত পুলিশ ইন্সপেক্টর মনিরুল ইসলাম, পুলিশ ইন্সপেক্টর আবু কয়ছর, ওয়াহিদুল ইসলাম অপু, জান্নাতুল ফাহিম, শহীদুল ইসলাম এবং খাদিম শাহসহ ৬জনের ময়নাতদন্ত সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সম্পন্ন হওয়ার পাশাপাশি র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল কালাম আজাদের ময়নাতদন্ত ঢাকা মেডিকেলে সম্পন্ন হয়েছিলো।

বোমা হামলায় যারা যেভাবে মারা গেলেন :

র‌্যাবের গোয়ন্দা বিভাগের প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল কালাম আজাদ: বোমা বিস্ফোরণে পর তার বাম দিকের চোখ দিয়ে একটা স্প্রীন্টার (ধাতব জাতিয় পদার্থ) মাথার পেছনে চলে যায়। যার কারণে তার মৃত্যু হয়।

পুলিশ ইন্সপেক্টর আবু কয়ছর: ময়নাতদন্তের সময় তার শরীর থেকে একটি স্প্রীন্টার (ধাতব জাতিয় পদার্থ) উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও তার মুখ, বাম চোখ, কপাল, বাম ও ডান পায়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

পুলিশ ইন্সপেক্টর মনিরুল ইসলাম: বোমা হামলায় নিহত মনিরুল ইসলামের শরীরের যখম পাওয়া যায় ১০টি। এছাড়াও তার শরীরে ছিল ২৪টি সেলাই। তলপেটে মারাত্মক দুটি বড় গর্ত ছিল। তার শরীর থেকে একটি স্প্রীন্টার (ধাতব জাতিয় পদার্থ) বের করা হয়।

ওয়াহিদুল ইসলাম অপু: স্প্রীন্টারের আঘাতে অপুর ডান চোখটি গলে গিয়েছিল। তার গলায়, বুকে, ডান হাতের বাহু, ডান পায়ে ৩টা জখম এবং বাম পায়েও গুরুতর যখম ছিল। ময়নাতদন্তে তার শরীর থেকে একটি স্প্রীন্টার (ধাতব জাতিয় পদার্থ) বের করা হয়।

জান্নাতুল ফাহিম: ময়নাতদন্তে ফাহিমের শরীরের অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। তার শরীরের মধ্যে ৩৫টি সেলাই ছিল। গ্রেনেডের স্প্রীন্টারে তার শরীরের কান, গলা, হাত-পা ও পায়ের উরুতে আঘাত রয়েছে। ময়নাতদন্তের সময় তার শরীর থেকে ১টি স্প্রীন্টার (ধাতব জাতিয় পদার্থ) বের করা হয়।

শহীদুল ইসলাম: বোমার আঘাতে শহীদুল ইসলামের তলপেটে স্প্রীন্টারের আঘাতে বড় ধরণের গর্ত হয়। তার ডান পা ও বাম দিকের বুকে জখমও রয়েছে। ময়নাতদন্তের সময় তার শরীর থেকে ৩টি স্প্রীন্টার (ধাতব জাতিয় পদার্থ) বের করা হয়।

খাদিম শাহ: বোমার স্প্রীন্টারের আঘাতে খাদিম শাহ’র বাম চোখ গলে যায়। কপাল, ডান হাতের বাহু, ডান পায়ের উরুসহ তার শরীরের ৫টি জায়গার গুরুতর যখম ছিল।

জানা যায়, মোগলাবাজার থানার এসআই শিপলু দাস (তৎকালীন) বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। আতিয়া মহল থেকে বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় একই থানার এসআই সুহেল আহমদ (তৎকালীন) বাদী হয়ে আরেকটি মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর প্রথমে থানা পুলিশের পাশাপাশি ঘটনার ছায়া তদন্তে নামে র‌্যাব এবং কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। একপর্যায়ে মামলার তদন্তভার পায় পিবিআই।

২০১৯ সালে ৭ সেপ্টেম্বর সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিবিআই এর পরিদর্শক (তৎকালীন) দেওয়ান আবুল হোসেন। এতে জহুরুল হক (২৫), তার স্ত্রী আর্জিনা বেগম (১৯) ও মোহাম্মদ হাসান (২৬) নামের তিন জঙ্গিকে অভিযুক্ত করা হয়। তারা সবাই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), যা বর্তমানে নব্য জেএমবি হিসেবে পরিচিত, এর সামরিক শাখার আত্মঘাতী সদস্য। জহুরুল ও তার স্ত্রী আর্জিনাকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে এবং হাসানকে কুমিল্লার চান্দিনা থেকে ২০১৭ সালে পৃথক জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সময় আটক করা হয় এবং পরবর্তীতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে তাদেরকে আতিয়া মহলের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। নিহত পাঁচ জঙ্গির মধ্যে চারজন আতিয়া মহলে অভিযানের সময় মারা যায় এবং আরেকজন মৌলভীবাজারের নাসিরপুরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয় বলে জানান তিনি।

আতিয়া মহলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান সমাপ্তের পরপরই মৌলভীবাজারের নাসিরপুর ও বড়হাট এলাকায় দুটি পৃথক জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শুরু করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। নাসিরপুরে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে সপরিবারে নিহত জঙ্গি লোকমান হোসেন ওরফে মোশাররফ হোসেন ওরফে সোহেলই নব্য জেএমবির এই আত্মঘাতী দলটির নেতা ছিলেন। আতিয়া মহলে অভিযানে নিহত চার জঙ্গির মধ্যে জহুরুল হক এর বোন মনজিয়ারা বেগম ওরফে মর্জিনা বেগম এবং তামিম আহমেদ ফরাজী।