বদর যুদ্ধঃ জেগে উঠেছে মানবতার সর্বপ্রধান বিজয়

প্রকাশিত: ৫:০৩ পূর্বাহ্ণ, |                          

!!মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান!!

দ্বন্দ্ব-সংঘাতের এই পৃথিবীতে আজ মানবতা নামক প্রত্যয়টি জাদুঘরে যাওয়ার উপক্রম। বাস্তব জগতে এই মানবতাকে পৃথিবীর কোন প্রান্তে খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবতাকে মানুষরূপী হায়েনারা ছিঁড়েফেড়ে করেছে অসুস্থ। আর অসুস্থতায় ভুগে ভুগে একদিন সে মৃত্যুর কোলে পড়বে ঢলে। হায়েনারা উল্লাসে মেতে উঠে নিষ্ঠুরতার নব ও চরমরূপ প্রকাশে হবে উদ্যোগী। পৃথিবীর আদি পিতা হযরত আদম (সা.) থেকে আজ অব্দি মানবতার বাণী ও রাজ উচ্চকিত হয়েছিল মানবতার পরম বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষকগণের দ্বারা। তবে আইয়্যামে জাহেলিয়ার যুগে যে সর্বকালের নিকৃষ্ট অমানবিকতার ও নিষ্ঠুরতার সয়লাব হয়েছিল তার অবসানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মানবতার বিজয়। সে বিজয় এসেছিল সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে।
মানবতা কী? এই প্রশ্নের উত্তর যদি আমরা খুঁজি বাংলা অভিধান তার শাব্দিক অর্থ দিয়েছে- মানুষের গুণ, মনুষ্য ধর্ম, মনুষ্যত্ব। আরবি হচ্ছে আল-ইহসান। ইংরেজিতে Humanity. মানুষ সেই প্রাণী যার ভিতর মনুষ্যত্ব আছে। আর যদি মনুষ্যত্ব বা মনন না থাকে তাকে মানুষ নয় প্রাণী বলতে হয়। মানবতা বা মানবিকতার সংজ্ঞায় অভিধানে যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে- ‘The qualities that make us human, such as the ability to love and have compassion, be creative, and not be a robot or alien.’ অর্থাৎ, সেই গুণসমুদয় যা আমাদের মানুষ হিশেবে তৈরি করে, যেমন ভালোবাসার ও সহ্য করার ক্ষমতা থাকবে, সৃজনশীল হবে, আর যান্ত্রিক বা ভিনগ্রহী হবে না। এখানেই মানবতার বা মানবিকতার স্পষ্ট ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে। আমরা অনেকেই প্রশ্ন তুলে থাকি যে, ধর্মের সাথে মানবতার কোন সম্পর্ক নেই। যিনি এ কথা বলেন তিনি প্রশ্নাতীত জ্ঞানপাপী বা স্বার্থান্বেষী। প্রত্যেকটি বস্তুর ধর্ম আছে। আগুন পুড়িয়ে ফেলে। পানি নিচুপানে গড়িয়ে যায়। বাতাস প্রবাহিত হয়। সূর্য নিয়মকরে পূবাকাশে উদিত হয়ে পশ্চিমাকাশে অস্ত যায়। আর এরা সকলেই ধর্মমেনে চলে বলেইতো সুশৃঙ্খলিত প্রকৃতি। মানুষের জন্য মহান রাব্বুল ইজ্জাত আল্লাহ যে নিয়ম করেছেন তা পালন করতে হয় ধর্মীয় বিধি-নিষেধ বা শরিয়াহ মেনে। আর যার প্রত্যেকটি অনুষঙ্গই মানবতার ধারক ও বাহক। আপনারা যদি ইসলামের প্রত্যেকটি বিধি-বিধান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেন তাহলে বুঝতে পারবেন যে সবকিছুই মানবতাকে উত্তমরূপে ধারণ ও লালন করে।
মহান আল্লাহ যুগে যুগে কালে কালে নবী-রাসূল আলাইহিস সালামগণকে যে পাঠিয়েছেন তা মানবতার ভুলুণ্ঠিত বাণীকে উচ্চকিত করে বাস্তবায়ন করতে। আল্লাহর প্রেরিত ও মনোনীত সেই সব প্রিয় বান্দাগণের কাজই ছিল আল্লাহর একত্ববাদ জমিনে প্রতিষ্ঠা করে অমানবিকতা ও মানবতার লাঞ্ছনাকে সরিয়ে সাম্যের ও মানবতার রাজ কায়েম করা।
প্রথম নবী হযরত নূহ (আ.) এর দ্বারা মানবতা মুক্তি পেয়েছিল এক মহাপ্লাবনের মাধ্যমে। নয়শ পঞ্চাশ বছর তিনি চালিয়েছিলেন তাঁর দাওয়াতি কাজ। চল্লিশ জোড়া প্রাণী আর তাঁর অনুসারীদের নিয়ে তিনি মানবতাকে আল্লাহর সহায়তায় বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। আর মানবতাকে যারা ভুলে হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানীতে লিপ্ত ছিল তারাই প্লাবনে ডুবে নিঃশেষ হয়ে যায়।
অনুরূপ ইবরাহিম (আ.) এর উপর নমরুদ ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা চালিয়েছিল অত্যাচার। ইবরাহিম (আ.) সাম্য ও মানবতার কবর রচনাকারীদের অনলকুণ্ডে বসে আল্লাহর প্রত্যক্ষ সাহায্যে পেয়েছিলেন বিজয়। সে বিজয়ের মাধ্যমে মানবতার বাণী ও বাস্তবতা ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মূসা (আ.) ও তদীয় ভ্রাতা হারুন (আ.) এর উপর ফেরাউনের কী জুলুম নির্যাতন চলছিল। আছিয়া (আ.) এর উপরও চলেছিল অত্যাচারের স্টিমরোলার। সেসময়কার সাধারণ মানুষদের প্রভু সেজে বসেছিল ফেরাউন। তাদের উপরও চলেছিল অমানবিক আচরণ। মূসা (আ.) নীলনদ পাড়ি দেয়ার সময় পেছন পেছন ফেরাউন ও তার সাঙ্গপাঙ্গ নেমে পড়েছিল। কিন্তু নদীর পানি আল্লাহর নির্দেশে তাদেরকে উল্টোদিকের তীরে উঠতে দেয়নি। সলিলসমাধি রচনা করে মানবতা ও সাম্যের জয়জয়কার করে দেয়। সে বিজয়টিও ছিল মানবতার ক’য়েকটি বিজয়ের অন্যতম বিজয়।
এরপর হযরত ঈসা (আ.)ও ইসলামের বাণী তথা একত্ববাদ ও মানবতাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যও প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তবে তিনি আল্লাহর কুদরতে পৃথিবী ছেড়ে দ্বিতীয় আসমানে অবস্থান করছেন। একসময় আবার আগমন করবেন পৃথিবীতে। নবী করিম মুহাম্মদ (সা.) এর এর দ্বীনের প্রচার-প্রসার করবেন। অতঃপর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ওফাত করবেন। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিনের প্রত্যেকজন নবী-রাসূল মানবতাকে করেছেন প্রতিষ্ঠা।
ইসলাম ও মানবতা কি বিপরীতমুখী? তা কখনওই নয়। বরঞ্চ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। যেমনটি মহান আল্লাহ তাঁর পবিত্র কুরানের সুরা আল মায়েদায় ইরশাদ করেছেন-
আজকের দিনে আমি দীন ইসলামকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নেয়ামতকে তোমাদের জন্য সম্পূর্ণ করে দিলাম। আর ইসলামকে একমাত্র দীন হিসেবে পছন্দ করলাম।
আর কোন পরিপূর্ণ বিষয়ে কোন প্রকার খাঁত থাকে না। ইসলাম ধর্ম পৃথিবীতে এসেছে মানুষের কল্যাণের জন্য। আর মানবতা যদি না থাকে তবে সেটা তো কোন ধর্মই হতে পারে না। ইসলামে মানবতার উপর আলোকপাত করা বিষয়াদি হচ্ছে,
মানুষের কল্যাণকর্ম তথা অধিকারের ক্ষেত্রে কারও কোন কমবেশী করার সুযোগ নেই এবং কোনরূপ সংশোধন করারও সুযোগ নেই। ইসলামে অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর সম্পর্কিত। শাসক-শাসিতের সম্পর্ক কেমন হবে তা উল্লেখ আছে। একইভাবে পিতা-মাতার উপর সন্তানের, সন্তানের উপর পিতা-মাতার অধিকার কেমন হবে তার ঘোষণা রয়েছে। অনুরূপভাবে স্ত্রীর উপর স্বামীর, স্বামীর উপর স্ত্রীর, নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, সঙ্গী-সাথী, গরীব-মিসকীন, নিঃস্ব, ইয়াতীম, মুসাফির, হিন্দু, খৃষ্টান, রোগী, অসহায় ব্যক্তি, শ্রমিক সহ পৃথিবীর সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে পরস্পরের উপর অধিকার কেমন হবে তা ইসলামে নির্ধারিত রয়েছে। এমনকি জীব-জন্তু, পশু-পাখির সাথেও কেমন আচার-আচরণ করতে হয় তার স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। উপরোক্ত বিষয়াদির সপক্ষে অনেক হাদিস রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে,
যালিলুল ক্বদর সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে জিনিসের মধ্যে প্রাণ আছে, তোমরা তাকে লক্ষ্যবস্ত্ত বানিও না’। (মুসলিম, মিশকাত হা/৪০৭৬ ‘শিকার ও যবেহ’ অধ্যায়।)
সুতরাং অনুমেয় যে, ইসলাম কতটুকু মানবতা ধারণ করে। আর সেই মানবতার প্রধানতম বিজয়টি এসেছিল বদর প্রান্তরে। আসুন জেনে নেই সেই বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, যুদ্ধ সংঘটন, ফলাফল ও পরবর্তিতে প্রভাব। তৎসঙ্গে জেনে নিব মানবতার কল্যাণে এই যুদ্ধের ভূমিকা।
নবী করিম (সা.) চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়ত পাওয়ার পর দীর্ঘ তের বছর মক্কাধামে চালিয়েছিলেন দাওয়াতি কাজ। প্রারম্ভে গোপনে। তারপর প্রকাশ্যে। কাফের মুশরিকদের অত্যাচারও সেভাবেই বাড়তে থাকে। ক’য়েকজন শাহাদাতের অমীয় সুধাও পান করেন। রাসূলে আকরাম (সা.) এর উপর আল্লাহর পক্ষথেকে আদেশ হলো স্বদেশ ত্যাগ করে মদিনায় গমনের। ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে রবিউল আউয়াল মাসে তিনি অলৌকিকতার সাথে টানটান বিপজ্জনক অবস্থা পেরিয়ে পৌঁছে গেলেন মদিনায়। আর মদিনাবাসী তাঁর আগমনে গেয়ে উঠলো,
“তালায়াল বাদরু আলাইনা মিন ছানিয়াতিল বিদা’ ওয়াজাবাশ শুকরু আলাইনা মাদাআ লিল্লাহি দা”।
নবী করিম (সা.) মদিনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হলেন। গোত্রে-গোত্রে বিভেদ ভুলিয়ে দিলেন। কন্যাসন্তানকে জীবন্ত সমাহিত করার পরিবর্তে তাদের জন্য প্রদান করলেন অনন্ত কালের জান্নাতের সুসংবাদ। নারীদের দিলেন সামাজিক মর্যাদা। তারা পেল সম্পত্তিতে অধিকার। পশু-প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতার হলো অবসান। দাসেরা পেল মুক্তি। গরীবেরা পেল তাদের ন্যায্য পাওনা। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা পেল নিরাপত্তা। চারদিকে শান্তির সুবাতাস বইতে লাগলো। এই মদিনা রাষ্ট্র হলো বিশ্বের সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ রোল মডেল।
আর উপর্যুক্ত উন্নতি, শান্তির বারতার স্ফুরণ, সাম্যবাদিতা, সরকার প্রধানের দায়বদ্ধতা, অপরাপর রাষ্ট্রের জনসাধারণ ও শাসকদের এই নীতি ও আদর্শের প্রতি আগ্রহ দেখে মক্কার জোচ্চোর, জ্ঞানপাপী ও ক্ষমতালিপ্সু কাফির বেঈমানদের গাত্রদাহ শুরু হয়। তাই তারা নানাভাবে এই চমৎকার ও অনিন্দ্য রাষ্ট্রটি এবং এটির কর্ণধার ইসলামের অনুসারী সাচ্চা মুমিনদের ধ্বংস করার ব্যর্থ প্রয়াস বারবার চালাচ্ছিল। নানামুখী ষড়যন্ত্র তারা চালাচ্ছিল। এভাবেই কেটে যায় রাসূলে আকরাম (সা.) এর পবিত্র হিজরতের একটি বছর। সদ্য জন্মনেয়া সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রটিও শিশুতে উপনীত হয়।
দ্বিতীয় হিজরি শুরু হয়। মুমিনদের সংযমের জন্য আল্লাহ তায়ালা বিধান নাজিল করলেন,
‘হে বিশ্বাসিগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের (রোযার) বিধান দেওয়া হল, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা সংযমশীল হতে পার।’ সুরা বাকারা (১৮৩)
কী আবেগ এই রোজা নিয়ে! এক উৎসবমুখর পরিবেশে চলছিল সিয়াম পালন। আর সেই প্রথম রোজার মাসের ১৭তম রোজা ভেঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন মুমিনগণ।
বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট অনুসন্ধানে যে তথ্যাদি হস্তগত হয় তাহলো, শান্তির সুবাতাসের মদিনার শান্তিকামী নতুন মুমিনগণ রাসূল (সা.) এর আগমণ ও সাম্যবাদিতার বারতায় আনন্দিত হয়। সেসময়কার অন্যতম খাজরাজ বংশের পৌত্তলিক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবায় ইবনে সলুলের জন্য নবনির্মিত স্বর্ণমুকুটটি শান্তির এই দূতের নিকট অর্পণ করে তারা। মানবতার ধারক সকলের প্রাণপ্রিয় নেতা রাসূল (সা.) সে মুকুট পরিধান না করে তা বিক্রি করে দুঃস্থদের সেবায় বিলিয়ে দেন। আর সেই স্বর্ণমুকুট হারানোর ব্যথায় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবায়। মক্কার কাফিরদের সাথে গোপনে যোগাযোগ করে ষড়যন্ত্র করে। আর বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংবিধান ও চুক্তি অনুযায়ী পরিচালিত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ফুঁসিয়ে তোলে কাফেরদের।
উপর্যুক্ত বিষয়াবলীসহ আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনকে নিশ্চিহ্ন করার মনোষ্কামনায় মক্কার বেদুঈন মুশরিক গোষ্ঠী ও মদিনার চক্রান্তকারী ছদ্মবেশী মুনাফিকেরা চক্রান্ত করে নবী করিম (সা.) ও ইসলামকে দুনিয়ার বুক থেকে চিরতরে উৎখাত করে দেওয়ার মানসে যুদ্ধের জন্য রণপ্রস্তুতি গ্রহণ করে। ঠিক সেসময়ে কুরাইশদের একটি ব্যবসায়ী দল কাফের নেতা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে যুদ্ধাস্ত্র কিনে মদিনা হয়ে সিরিয়া থেকে মক্কা অভিমুখে যাচ্ছিল। মদিনায় পথিমধ্যে তাদের রসদ লুট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মক্কায় গোপন বিপৎসংকেত পাঠায়। এই সংবাদ শ্রবণমাত্রই হঠকারী কাফির সরদার আবু জেহেল এক সহস্র অশ্বারোহী সশস্ত্র যোদ্ধাসহ মদিনা অভিমুখে রওয়ানা দেয়। গোপন সূত্রে এ সংবাদ জানতে পেয়ে মহানবী মুহাম্মদ (সা.) জীবনের প্রথম রোজাদার সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ মজলিশে বসলেন। সাহাবায়ে আজমাইনের সুদৃঢ় ঈমানি চেতনা ও ইস্পাত কঠিন মনোবল দর্শনে হযরতে আকরাম (সা.) অত্যন্ত প্রীত হলেন।
মুশরিক নেতা আবু জেহেলের যুদ্ধ যাত্রার খবর শুনে দ্বিতীয় হিজরির রমজান মাসের ১২ তারিখে গোটা জাহানের ত্রাণকর্তা স্বয়ং সেনাপতি রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর নিরেট মুমিন শাহাদাতের অমীয় শুধা পানে প্রস্তুত ৬০ জন মুহাজির ও ২৫৩ জন মাক্কি আনসারসহ মোট ৩১৩ জন সাহাবি সঙ্গে নিয়ে শত্রু বাহিনীকে বাধা প্রদান ও দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার জন্য মদিনা থেকে যাত্রা শুরু করে ৮০ মাইল দূরে বদর প্রান্তরে উপস্থিত হলেন।
হিজরি দ্বিতীয় সালের ১৭ রমযান (৬২৪ ঈসায়ী সালের ১৩ মার্চ) ‘আশহুরে হুরুম’ বা যুদ্ধনিষিদ্ধ মাস চতুষ্ঠয়ের অন্যতম রমজানেই মদিনা আক্রমণ করে বসে কাফেররা। আর তার বিপরীতে মুসলিমগণ গ্রহণ করেছিল আত্নরক্ষামূলক যুদ্ধের কৌশল। সংঘটিত হলো সত্য-অসত্যের চূড়ান্ত ফয়সালাকারী ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ।
আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাসী মুসলমানদের অস্ত্র ছিল মাত্র তিনটি ঘোড়া, ৭০টি উট, ছয়টি বর্ম ও আটটি তলোয়ার। উপর্যুক্ত রসদ কম মনে হলেও বিজয়লাভের তাদের প্রধান উপকরণ ছিল ঈমানী শক্তি। যেখানে সরঞ্জামাদি ও সংখ্যা নয়। রাসূলে আকরাম (সা.) তার সাহাবাদের জিহাদ সম্বন্ধে নসিহত ও উদ্দীপনামূলক ভাষণ প্রদান করলেন। যুদ্ধে বিজয়লাভ করা সংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্র, দুর্বল প্রতিপক্ষ ও সরঞ্জামাদির আধিক্যের ওপর নির্ভর করে না। এ মহাপরীক্ষার ক্ষেত্রে মহান সৃষ্টিকর্তার উপর অবিচল বিশ্বাস রেখে ধৈর্য অবলম্বন করা এবং অবিচল থাকাই জয়লাভের একমাত্র ও প্রধান উপায়—এ বাস্তব ও পালনীয় কথাগুলো তিনি উত্তমরূপে সাহাবিদের হৃদয়ঙ্গম করিয়ে দিলেন।
যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে নবী করিম (সা.) আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেছিলেন, তাঁর দোয়া কবুল করে মাবুদ মেহেরবান বদর যুদ্ধে ফেরেশতা দিয়ে মুজাহিদদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিলেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যখন তুমি মুমিনদের বলছিলে, “এটা কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে তোমাদের প্রতিপালক প্রেরিত তিন সহস্র ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সহায়তা করবেন?” হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যদি তোমরা ধৈর্যধারণ করো এবং সাবধান হয়ে চলো, তবে তারা দ্রুতগতিতে তোমাদের ওপর আক্রমণ করলে আল্লাহ পাঁচ সহস্র চিহ্নিত ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সাহায্য করবেন।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১২৪-১২৫)
আরবে তৎকালীন একটি যুদ্ধ প্রথা প্রচলিত ছিল যে, প্রথমেই উভয়পক্ষের একজন করে নির্বাচিত ব্যক্তির মধ্যে মল্লযুদ্ধ হবে। তারপর মূল যুদ্ধ শুরু হবে। সেই প্রথানুসারে প্রথমে সংঘটিত মল্লযুদ্ধে মুসলিম বীরযোদ্ধাদের হাতে কাফের বাহিনী পরাজিত হয়। এরপর হক ও বাতিলের, আলো ও আধারের, বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর উভয় বাহিনী পরস্পর সম্মুখীন। দুই পক্ষের তুমুল যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী বীরবিক্রমে লড়াই করে ইসলামের বিজয় কেতন ছিনিয়ে আনেন। যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে রাসূলে আকরাম (সা.) ইরশাদ করেছিলেন, ‘আজ যে ব্যক্তি কাফিরদের বিরুদ্ধে ধৈর্যের সঙ্গে সওয়াবের প্রত্যাশায় যুদ্ধ করবে, শহীদ হবে, আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন।’ (বায়হাকি)
ওরকমটি আশ্বাসবাণী পেয়ে হক ও বাতিলের লড়াইয়ে স্বল্পসংখ্যক মুসলমান জানবাজি রেখে কাফেরদের মোকাবিলায় জয়লাভ করেছিলেন। বদর যুদ্ধে ৭০ জন মুশরিক নিহত ও ৭০ জন বন্দী হয়। অন্যদিকে মাত্র ১৪ জন মুমিন বীর সেনানী শাহাদাতের অমীয় সুধা পানে অমর হন।
তার মধ্যে ছয়জন ছিলেন মোহাজের সাহাবি অপর আটজন সাহাবি ছিলেন আনসার।
কাফেরদের বহু অস্ত্র ও রসদপত্র গণিমত হিশেবে বিজয়ী মুসলিমদের হস্তগত হলো।
বুখারির বর্ণনা মতে অনেক সাহাবি দেখেছেন এবং বলেছেন যে আমরা সাদাপোশাক পরিহিত কিছুসংখ্যক ব্যক্তিকে আমাদের পাশেদাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে দেখেছি।তাদেরকে আমরা যুদ্ধেরআগে কখনো দেখিনি এমনকি যুদ্ধের পরেও দেখিনি।আবার কিছুসংখ্যক সাহাবি বলেছেন, আমরা তরবারি ব্যবহারকারীকে দেখছি না, কিন্তু তরবারিটি দেখছি।তাদের তরবারিগুলো আমাদের তরবারিগুলোর চেয়ে দৈর্ঘ্যে অনেক লম্বা এবং সেগুলো শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করছিল।
সেদিন সাদা পোশাক পরিহিত ফেরেশতাদের আকৃতি কারো চোখে দেখা গিয়েছিল আবার
কারোচোখে দেখা যায়নি। মূলত তারা ছিল আল্লাহর প্রেরিত ফেরেশতা। মুসলমানদের হয়ে বদরের প্রান্তরে তারা যুদ্ধকরেছিলেন। অপরপক্ষে সেদিন মক্কাবাসীকাফেরদের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য অভিশপ্ত ইবলিসও এসেছিল। আর ইবলিস এসেছিল সোরাকা নামক একজন ব্যক্তির আকৃতি ধরে। কিন্তু মক্কাবাসী পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাঠে নেমে যখন সেইইবলিস দেখল আল্লাহর ফেরেশতাগণ মুসলমানদের পক্ষহয়ে যুদ্ধরত মাঠে বিদ্যমান, ঠিক তখন ইবলিস পালিয়েযেতে লাগল। কাফেরদের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে উঠল, সোরাকা তুমি কোথায় যাচ্ছো? সোরাকা তুমি কি বলোনি যে, তুমি আমাদের সাহায্য করবে? আমাদেরকাছ থেকে দূরে সরে যাবে না? সে সময় ইবলিস(ছদ্মবেশে সোরাকা) বলল, আমি এখানে এমন কিছুদেখতে পাচ্ছি যা তোমরা দেখতে পাও না। আল্লাহ্কেআমার ভয় হচ্ছে, তিনি কঠোর শাস্তিদাতা। এরপর ইবলিস আত্মগোপন করেছিল।
বদরের যুদ্ধ ছিল মুমিনদের জন্য প্রথম সম্মিলিত এবং যতটুকু সম্ভব পরিকল্পিত যুদ্ধ। এই মরুভূমির যুদ্ধে রাতে বৃষ্টি মুসলিমদের পক্ষের জায়গাকে সুন্দর ও মজবুত করেছিলো। পক্ষান্তরে জোচ্চোর মুশরিকদের স্থানকে করেছিল কাদাযুক্ত। যা তাদের জন্য ব্যাপক লজ্জার ও পরাজয়ের কারণ।
দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব অর্জন ও মাতৃভূমি রক্ষায় জীবনদানকে মহানবী (সা.) শাহাদতের সম্মানজনক মর্যাদা দিয়েছেন। শহীদদের মর্যাদা বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদের কখনোই মৃত মনে কোরো না, বরং তারা জীবিত ও তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে জীবিকাপ্রাপ্ত।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬৯) যে জীবন মহান রব আমাদের দিয়েছেন সে জীবন তাঁর পথে ব্যয় করার থেকে উত্তম কাজ আর কী থাকতে পারে?
যে ইসলামের যাত্রা শুরু হয়েছিল হেরাগুহায় ধ্যানমগ্ন রাসূল (সা.) এর ওহি প্রাপ্তির মাধ্যমে ১৭ রমজান বদর যুদ্ধ থেকেই আরম্ভ হয় সেই ইসলামের মহাজয় যাত্রা।
যেহেতু এইদিন কাফের-বেঈমানদের সাথে
মহাসত্য ইসলামের পার্থক্য সূচিত হয়েছিল তাই এ দিবসকে ইয়াওমুল ফুরকানবা সত্য-মিথ্যার পার্থক্যের দিন বলা হয়।
মানতার সর্বোচ্চ বিজয় যে বদর যুদ্ধ তা যুক্তিযুক্ত ও প্রমাণিত। মানবতা কি তবে আজ ভুলুণ্ঠিত হবে জ্ঞানপাপী ও স্বার্থান্বেষী মহলের কুচক্র দ্বারা? আমাদের কি নেই কোন করণীয়? আমাদের কাছে আজ জ্বলজ্বল করছে উপর্যুক্ত মানবতার বিজয়গুলি। আমাদের কাছে বর্তমান পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ও সংবিধান। আমরা পেয়েছি সন্দেহাতীত এক আদর্শ ও নেতা। তবে কেন এই নীরবতা? কেন এই উদাসীনতা? কেন গড্ডালিকাপ্রবাহে ভেসে যাচ্ছি আমরা? কুরান নাজিলের এ মাসে; মানবতার সর্বপ্রধান বিজয়ের এই মাসে পারি নাকি নিজের কর্তব্য নির্ধারণ করতে? জেগে উঠুন মুমিন! জেগে উঠুন মানবতার সর্বোত্তম লালনকারীগণ! ছিঁড়েফিড়ে অসুস্থ হওয়া মানতাকে করি পরিপুষ্ট। মানবতাকে আবারো বিজয়ী করতে দীপ্ত চেতনা নিয়ে হই আগুয়ান। অনাচার, পাপাচার ইত্যাদি থেকে মুক্ত করি দেশ, জাতি সমাজকে! তাই আসুন আমরা আজ পবিত্র রমজানের এই মহান বিজয় দিবসের শিক্ষা সর্বত্রই ছড়িয়ে দেই। মানবতার বাণীকে করি উচ্চকিত!

লেখক;কলামিষ্ট ও গবেষক।