আন্তর্জাতিক নারী দিবস : আলোকিত জাতি গঠনে নারী শিক্ষার বিকল্প নেই ‘.
তাইজুল ফয়েজ,
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কশিনের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী উরসুলা ফন ডার লেন বলেন নারীদের এগিয়ে আনা, সামাজিক সুরক্ষা এবং দারিদ্র কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন । নারীর ক্ষমতায়নে একটি হাতিয়ার হলো জ্ঞান অর্জন করা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট জীবনের শৈশবের ১৩ বৎসর ফ্রান্সে কাটিয়েছিলেন।২০১৯ সালে ফ্রান্সের পার্লামেন্ট ভবনে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্ববর্তী সংগঠন ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি(ইইসি)-এর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ছিলেন তাঁর বাবা এর্নস্ট আলব্রেখট৷ বাবার কর্মস্থল ব্রাসেলস-এ ১৯৫৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন ফন ডেয়ার লাইয়েন৷ সেই সুবাদে ফরাসি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন তিনি। মাতৃভাষা জার্মানের সঙ্গে ফরাসি ও ইংরেজি জানেন সমানভাবে।এ কারণে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট পদে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অতুলনীয়।
নারীদের উন্নয়নে ও ক্ষমতায়নে নারী শিক্ষার বিকল্প নেই।
সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন
” বিশ্বে যা কিছু মহান চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। এই সত্য আজও আমাদের সমাজে বাস্তবে রূপ ধারণ করেনি । আমরা উন্নত বিশ্বের কথা বলি না কেন। নারী সমাজকে পিছনে রেখে আলোকিত জাতি গঠন ও উন্নত বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ এর জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৬ লাখ। ৮ কোটি ২৪ লাখ পুরুষ এবং নারী ৮ কোটি ২২ লাখ।
বিশ্বে নারী-পুরুষের অনুপাত হল ১০১ জন নারীর বিপরীতে ১০০ জন পুরুষ।
বাংলাদেশের ৮ কোটি ২২ লাখ নারীর হাত ১৬ কোটি ৮৮ লাখ হাতকে কাজে লাগাতে পারলে দেশ ও জাতির উন্নয়ন সম্ভব। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে নারী সমাজকে পিছেয়ে রাখা হচ্ছে। বঞ্চিত করা হচ্ছে তাদের অধিকার ও জ্ঞান অর্জন থেকে। পৃথিবীর কোন ধর্মে নারীর জ্ঞান অর্জনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়নি।নারী-পুরুষের জ্ঞান অর্জনকে ফরজ করা হয়েছে। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে নারীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ও বৈষম্য সৃষ্টি করে প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ধর্ম, দেশ ও উন্নত জাতি গঠনের স্বপ্ন ।
ফরাসি বিপ্লবের জেনারেল ও ফ্রান্সের সম্রাট
নেপোলিয়ন বলেছিলেন
আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও,
আমি শিক্ষিত জাতি দেব।
এইজন্য বলা হয় নারী শিক্ষার উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল ফ্রান্স থেকে।
আমরা যদি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারি দেশ বদলে যাবে। ইউরোপীয়ান নারীরা এগিয়ে থাকার কারণ তাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায়,সমাজ ব্যবস্থায় কোন বৈষম্য নেই। আইনের রয়েছে যথার্থ প্রয়োগ।রাস্তায়- পার্কে, বাজার -বন্দর, বাস -ট্রেন, অফিস-আদালত সর্বক্ষেত্রে রয়েছে তাদের পদচারণা কোন ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয় না। রয়েছে মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা । দিন রাত সমানতালে এগিয়ে চলছেন নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের পাশাপাশি দেশ ও জাতি গঠনের কাজে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের মানুষের ধ্যান-ধারণার তেমন পরিবর্তন হয়নি। এখনও সমাজের প্রতিটি স্তরে স্তরে নারীদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। অশিক্ষা, দারিদ্র্য আর কুসংস্কারে ডুবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীর প্রথম বাধাটা আসে পরিবার থেকে। যে বাধার শিকার হয়েছিলেন সাখাওয়াত হোসেন বেগম রোকিয়া । নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে নারী শিক্ষার উন্নয়ন একটি অন্যটির পরিপূরক।
উন্নয়নশীল দেশের নারী হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা নারী উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়।
দেশে এখন প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দু’জন নারী। জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী। দেশের সিনেট স্তরের পুরুষরা তাদেরকে যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করেন নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ।প্রকৃতপক্ষে আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকার কারণে সমাজের মধ্যবিত্ত ও গ্রাম গঞ্জের সাধারণ পরিবারের মেয়েরা কম-বেশি সহিংসতা ও বৈষম্যের শিকার। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই নারী, কিন্তু নারীর অগ্রগতি ও উন্নয়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে খুব অল্প।
নারীশিক্ষার বিষয়টি আমাদের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে অপরিহার্যভাবে জড়িত। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে এখন নারীদের অংশ গ্রহণ শতভাগ হলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হবে না। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের শিক্ষার ব্যয় ভার সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে। নারীর সমাধিকার ও নারীমুক্তির কথা যতই বলা হোক না কেন।
বাল্যবিবাহ, পারিবারিক ও সমাজ ব্যবস্থার কারণে নারী শিক্ষার উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে কাঙ্খিত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। যৌনতা ও ইভটিজিং তার প্রধান কারণ সমাজের রাজনীতিবিদ ও উচ্চ শ্রেণীর সমাজ পতিদের ছেলেদের দ্বারা ইভটিজিং সংঘটিত হয়। এজন্য আইন থাকলেও তার কার্যকর প্রয়োগ করতে পারে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তনু হত্যা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। সাংবাদিক সাগর-রুনির হত্যারহস্য উদঘাটন করতে পারেনি প্রশাসন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এর হিসেবে গত বছর ২৫৮ জন নারী ইভটিজিংসহ যৌন হয়রানীর শিকার হয়েছেন৷ এরমধ্যে ১৮ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন৷ দুইজন ছাত্রী স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন৷
মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠন। বাংলাদেশের সংবিধান দ্বারাও তা স্বীকৃত। কিন্তু প্রায় ৫০ বছরেও তা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি যা জাতির জন্য দুঃখজনক। নারী-পুরুষের সমান স্বার্থ রক্ষাকারী আইন প্রবর্তন ও আইনের সঠিক বাস্তবায়ন হলে নারীরা পাবে তার মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। নারীর প্রতি ইতিবাচক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিই নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করতে পারে। গ্রামের মেয়েরা শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণে শতকরা ৯০শতাংশ মেয়েরা বিয়ের প্রথম বছর মা হয়ে য়ান।পারিবারিক অসচেতনতার কারণে এবং আর্থিক সংকটে পড়ে গর্ভকালীন সময়ে অপুষ্টিতে ভোগেন।
১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সেলাই কারখানায় বিপদজনক ও অমানবিক কর্মপরিবেশ, স্বল্প মজুরী এবং দৈনিক ১২ ঘন্টা শ্রমের বিরুদ্ধে নারী শ্রমিকরা প্রতিবাদ করে। এরপর বিভিন্ন সময়ে ৮ মার্চে উল্লেখযোগ্য আরো ঘটনার ধারাবাহিকতায় ১৯১০ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সন্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাবে ৮ মার্চকে আর্ন্তজাতিক নারী দিবস ঘোষণা করা হয়। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সাল থেকে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন শুরু করে।তখন থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি উদযাপন করা হয়।
নারী দিবস হচ্ছে সেই দিন জাতিগত, গোষ্ঠীগত, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে বৈষম্যহীনভাবে নারীর অর্জনকে মর্যাদা দেয়ার দিন।
একমাত্র শিক্ষাই পারে নারীকে সমর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে। নারীকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয়ভাবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। এর ফলে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা শিক্ষিত হয়ে পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হবে।