কনস্যুলেট জেনারেল মিলানের  আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন

প্রকাশিত: ২:৪৭ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২২ | আপডেট: ২:৪৭:অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২২

 

রিয়াজুল ইসলাম কাওছার, ইতালি থেকে :

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি” ভাষা শহিদ দের স্মরণে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল, মিলান ইতালির আয়োজনে যথাযোগ্য ভাবগাম্ভীর্য ও মর্যাদার সাথে মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়েছে।

দিবসটি পালনের অংশ হিসাবে কনসাল জেনারেল এম জে এইচ জাবেদ একুশের প্রথম প্রহরে প্রভাতফেরীর মাধ্যমে কনস্যুলেট জেনারেলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনারে বেদীতে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন।ও একমিনিট নিরবতা পালন করেন।এসময়ে প্রবাসী বাংলাদেশী, ইতালিয় ও অন্যান্য দেশের নাগরিকরাও অংশনেয়।
দিনটিতে কনসাল জেনারেল কনস্যুলেট জেনারেলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে অফিস প্রাঙ্গণে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করেন। বিকালে জুম মিটিং এর মাধ্যমে ভারচ্যুয়াল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। পবিত্র কোরআন থেকে তোলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হয় আলোচনার প্রথম পর্ব। ভাষা শহিদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় এসময়। দিবসটিতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর প্রদত্ত প্রেরিত বাণী পড়ে শোনান দুতালয় প্রধান কনসাল সামসুল আহসান এবং শ্রম কনসাল সাব্বির আহমেদ। পরে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ক্রমবিকাশের উপর ভিত্তি করে একটি বিশেষ প্রামান্যচিত্র চিত্র প্রদর্শন করা হয়। আলোচনাপর্বে মিলান লোম্বার্দিয়া আওয়ামী লীগ,মিলান বাংলা প্রেসক্লাব ইতালির সাংবাদিক নেত্রীবৃন্দ সহ প্রবাসী বাংলাদেশীরা অংশ নেন। তাঁরা সকল ভাষা শহিদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। সেই সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর প্রতিও বিনম্র শ্রদ্ধা ঞ্জাপন করেন।
কনসাল জেনারেল এম জে এইচ জাবেদ-এর সঞ্চালনায় আলোচনার দ্বিতীয় পর্বে আলোচনায় যুক্ত হন ইতালির বলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা লুইজা ব্রুনলি। তিনি বলেন, মাতৃভাষার মাধ্যমেই একটি শিশু নিজেকে প্রকাশ করতে শেখে এবং তার মস্তিস্ক মাতৃভাষার শিক্ষাই প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করতে পারে। মুক্তিযোদ্ধা সাজ্জাদ আলী জহির (বীর প্রতীক) তাঁর বক্তব্যে ভাষা আন্দোলনে ক্রমবিকাশ পর্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন উর্দুকে ইসলামের ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করে এ অঞ্চলের মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলেও সেটা সম্ভব ছিলনা, কেননা উর্দু প্রকৃত অর্থে ইসলামের ভাষা নয়, এটি মূলত: তুর্কি প্রভাবিত একটি ভাষা। তিনি বাংলাদেশ-ইতালির দীর্ঘ কূটনৈতিক সম্পর্কের কথা তুলে ধরে অভ্যাগত ইতালিয় অতিথিদের অনুষ্ঠানে অংশ্রগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানান এবং বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পাশে থাকায় ইতালিয় নাগরিক মরহুম ফাদার মারিনো রিগনের কথা স্মরণ করেন।এছাড়া ইউনেস্কো প্রতিনিধি ড.
আনতোনেল্লা কাসিজি বহুভাষিক শিক্ষা বিকাশে বিশ্বব্যাপী ইউনেস্কোর কার্যক্রমের কথা তুলে ধরেন। ভাষা শিক্ষায় প্রযুক্তি ব্যবহার এবং প্রাথমিক শিক্ষার বিকাশে মাতৃভাষার অপরিসীম গুরুত্বের কথা তুলে ধরে তিনি সবাইকে মাতৃভাষার বহুল চর্চার আহবান জানান। একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আনয়নে তিনি বাংলাদেশ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি, এম.পি , তিনি বলেন এই দিবসের অনুপ্রেরণা বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি আরো বলেন, জাতির পিতার হত্যাকান্ডের পর বাংলাদেশের ইতিহাস চরমভাবে বিকৃত করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে আমরা সঠিক ইতিহাস বিশ্বব্যাপী তুলে ধরতে পারছি। ভাষা আন্দোলনে ছাত্র হত্যাকে পরিকল্পিত হত্যাকান্ড হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, এর মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপন করা হয়েছে যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বিপুল ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে। তিনি আরও বলেন, বাংলা একটি সমৃদ্ধ ও অভিযোজনক্ষম ভাষা, যাতে আট হাজারেরও বেশি বিদেশি শব্দ রয়েছে। ইতালির মত বাংলাদেশেরও সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে যে আড়াই হাজার বছর আগেও এ অঞ্চলে সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। তিনি দেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নে প্রবাসীদের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, বর্তমান সরকার তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে সচেতন রয়েছে। প্রবাসীদেরকে তাদের সন্তানদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি আত্মস্থ করার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন এর মাধ্যমেই তারা প্রকৃত অর্থে আন্তর্জাতিক নাগরিক হয়ে উঠতে পারবে।
অনুষ্ঠানের সভাপতি কনসাল জেনারেল এম জে এইচ জাবেদ তার বক্তব্যে বলেন, বিশ্বায়নের যুগে মাতৃভাষাকে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত রেখেই অন্যান্য ভাষা আয়ত্ব করতে হবে। সম্মানিত অতিথিদের অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন যে, মিলান কনস্যুলেট ইতালিতে বাংলদেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে অনুরূপ প্রয়াস অব্যাহত রাখবে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, ইতালি ও বাংলাদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন বিনির্মানে আগমী দিনগুলোতে সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গঠনমূলক কর্মসূচী বাস্তবায়ন সম্ভবপর হবে।
ভয়াল করোনা মহামারির এই ক্রান্তিকালের জন্যই বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল মিলান ইতালি আংশিক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। প্রবাসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে প্রবাসে বংশোদ্ভূত আমাদের নতুন প্রজন্ম জানবে বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস এমনটি প্রত্যাশা সবার।