বিধ্বস্ত গাজা পুনর্গঠনে লাগবে কয়েক বছর

প্রকাশিত: ৩:১৭ অপরাহ্ণ, মে ২৩, ২০২১ | আপডেট: ৩:১৭:অপরাহ্ণ, মে ২৩, ২০২১

ইসরাইল-হামাস যুদ্ধবিরতির পর প্রায় দুদিন পার হয়েছে। আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে মুসল্লিদের ওপর হামলা ছাড়া আর কোনো ক্ষেপণাস্ত্র বা বিমান হামলা চালায়নি ইসরাইলি বাহিনী। রকেট ছোড়েনি হামাসও। আশ্রয়শিবির থেকে অবরুদ্ধ গাজায় নিজেদের বিধ্বস্ত ঘরবাড়িতে ফিরে আসছে হাজার হাজার উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনি।

টানা ১১ দিনের আগ্রাসনে শহরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। দ্য ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রসের (আইসিআরসি) মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক পরিচালক ফ্যাব্রিজিও কারবনি বলছেন, ‘গাজায় শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য অবকাঠামোর যে ক্ষতি হয়েছে তা পুনর্নির্মাণে তথা সবকিছু আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এক দশক না লাগলেও কয়েক বছর লেগে যাবে।’

একই কথা বলছে হামাস কর্তৃপক্ষও। এর জন্য ২২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের মতো অর্থের প্রয়োজন হবে বলে জানিয়েছে তারা। যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় দিন (শনিবার) থেকেই ফিলিস্তিনে ঢুকতে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা। সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ কারেম শালোম ক্রসিং দিয়ে মিসরের পাঠানো ত্রাণবোঝাই ১৩০টি ট্রাকের বিশাল বহর ইতোমধ্যে গাজায় এসে পৌঁছেছে।

জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহের জন্য শুক্রবার ক্রসিংটি খুলে দেয় ইসরাইল। ‘লং লিভ ইজিপ্ট ফান্ড’র তত্ত্বাবধানে পাঠানো এসব ট্রাকে দুই হাজার ৫০০ টন খাদ্য, ওষুধ ও পোশাকসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা সামগ্রী রয়েছে। এ ছাড়া এক কোটি ৮৬ লাখ ডলারের জরুরি মানবিক সহায়তা পাঠিয়েছে জাতিসংঘ। ২০ লাখ ডলারের জরুরি সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে চীন। সেইসঙ্গে দুই লাখ ডোজ করোনা-টিকা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে দেশটির পক্ষ থেকে। শিগগিরই এসব সহায়তাও এসে পৌঁছবে। ত্রাণ পাঠাবে যুক্তরাষ্ট্রও। তবে হামাস প্রশাসনকে নয়, সরাসরি ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস সরকারের হাতে যাবে মার্কিন তহবিল।

টানা ১১ দিনের সংঘাতের পর বৃহস্পতিবার মিসর, কাতার ও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় ইসরাইল ও হামাস। কার্যকর হয় শুক্রবার স্থানীয় সময় রাত ২টা থেকে। তবে যুদ্ধবিরতির কয়েক ঘণ্টা পরই আল-আকসা মসজিদে জুমার নামাজের পর ফিলিস্তিনি মুসল্লিদের ওপর হামলা চালায় ইসরাইলি বাহিনী। এ ছাড়া শনিবার পর্যন্ত বিমান হামলা বা রকেট ছোড়ার মতো বড় কোনো ঘটনা ঘটেনি। যুদ্ধবিরতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে তেল আবিব ও ফিলিস্তিনে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে মিসর। এমবিসি টিভিতে এক সাক্ষাৎকারে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ শুকরি বলেছেন, ফিলিস্তিন-ইসরাইল বিষয়টি সবসময় মিসরের সরকার ও জনগণের কাছে অগ্রাধিকার পাবে।

আলজাজিরা জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরপরই গাজায় ফিরতে শুরু করেন উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিরা। শনিবার পর্যন্ত নিজেদের বাড়িতে ফিরে এসেছেন বেশ কয়েক হাজার বাসিন্দা। ইসরাইলি হামলায় ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই নিয়েছিলেন তারা। তবে ফিরে আসার পর তারা দেখছেন, তাদের বেশিরভাগ ঘরবাড়িই একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। বেঁচে থাকার তাগিদে সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এখন চলছে জীবনের রসদ সংগ্রহের কাজ। যেমনটা বলছিলেন আলজাজিরার প্রতিবেদক হ্যারি ফসেট। শনিবার সকালে গাজা শহর থেকে এক প্রতিবেদনে তিনি বলেন, ‘মানুষ ফিরে এসেছে। কিন্তু তারা এখন কার্যত রাস্তায় রয়েছেন। আগ্রাসনপূর্ব স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছেন তারা।’

গত কয়েক দিনে ইসরাইলি বোমারু বিমানের তাণ্ডবে শহরের বেশ কিছু স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পানি ও জ্বালানি অবকাঠামোসহ শিল্পকারখানা কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে থমকে গেছে টিকাকরণ ও প্রয়োজনীয় পরিষেবা। এই করোনা অবস্থায় স্বাস্থ্য পরিষেবা এখনো স্তব্ধ। গাজায় জাতিসংঘের এক কর্মকর্তার মতে, সকাল থেকে সন্ধ্যা কার্যত বিদ্যুৎহীন। রাতের দিকে দুই থেকে তিন ঘণ্টার জন্য পরিষেবা মিলছে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, গাজায় প্রায় আট লাখ মানুষের কাছে পানি পৌঁছাচ্ছে না।

হামাস জানিয়েছে, ইসরাইলি বোমারু বিমান বেছে বেছে টার্গেট করেছে গাজার শিল্প-তালুক এবং বিভিন্ন কারখানা। অন্তত এক হাজার বাড়ি একেবারে ধ্বংস হয়েছে, আরও সাত শতাধিক বাড়ির বেশিরভাগ অংশ ধ্বংস হয়েছে এবং ১৪ হাজার ঘরবাড়ি কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাজার নিয়ন্ত্রক হামাসের মুখপাত্র সালামেহ মারুফ ক্ষয়ক্ষতির একটা প্রাথমিক হিসাব দিয়েছেন। তার হিসাব অনুযায়ী, গাজা উপত্যকায় সবকিছু মিলিয়ে গত ১১ দিনে মোট ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ২২ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আবাসন ও এনজিও খাতে, পরিমাণ ৯.২ কোটি। ৪ কোটি ডলার ক্ষতি বাণিজ্য ও শিল্প খাতে। সড়ক যোগাযোগ, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন অবকাঠামোর ক্ষতি ২.৭ কোটি ডলার। সরকারি ভবনে ক্ষতি ২.৩ কোটি ডলার। বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় ক্ষতি হয়েছে ২.২ কোটি ডলারের। আর কৃষিখাতে হয়েছে ২.৪ কোটি ডলারের। এ পরিস্থিতিতে গাজা শহরকে নতুন করে গড়ে তুলতে কয়েক বছর সময় লেগে যাবে বলে মনে করছে হামাস কর্তৃপক্ষ। ক্ষতির হিসাব দিয়েছে অধিকৃত পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সরকারও। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) হিসাবমতে, ইসরাইলি হামলায় পশ্চিম তীরের শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও কৃষিখাতে যে ক্ষতি হয়েছে তা পুনর্গঠনে ১০ কোটি ডলার প্রয়োজন হবে।

তবে এ বিশাল পরিমাণ অর্থ জোগানোই এ মুহূর্তে ফিলিস্তিনিদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আলজাজিরার হ্যারি ফসেট বলেন, ‘গাজায় ইতোমধ্যে কিছু মানবিক সহায়তা এসে পৌঁছেছে। তবে আগামী দিনগুলোতে এখানকার ডাক্তার, হাসপাতাল ও ত্রাণ সহায়তা সংগঠনগুলোর জন্য বিশাল এক কর্মযজ্ঞ পড়ে রয়েছে। তবে তারা পুনর্নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও অর্থের জোগান পাবে কিনা এবং ইসরাইলি আগ্রাসনের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।’

জাতিসংঘের ফিলিস্তিনবিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড ন্যাশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্ক এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজি (ইউএনডব্লিউআরএ) বলেছে, ঘরবাড়ি হারানো কয়েক হাজার অধিবাসীকে চিহ্নিত করে সহায়তা পৌঁছে দেওয়াই এখন তাদের প্রধান কাজ। এজন্য প্রায় জরুরি ভিত্তিতে প্রায় তিন কোটি ৮০ লাখ ডলারের তহবিলের আবেদন জানিয়েছে সংস্থাটি।